শাড়ির জগতে টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ির রয়েছে আলাদা কদর। প্রায় দুই শতাব্দি ধরে এ শিল্পের বিকাশ ঘটেছে জেলায়। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন স্বত্ব আদায় করে নেয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।
“টাঙ্গাইল শাড়ি”র বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতি আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন জেলার ব্যবসায়ী ও সুধীজনেরা। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
সূত্রপাত
বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ির উৎস পশ্চিমবঙ্গ- সম্প্রতি এমনটা দাবি করে ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। বিতর্কিত দাবিটি মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল পেজে একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে করা হয়েছিল, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা ও হাস্যরসের জন্ম দেয়।
পোস্টে দাবি করা হয়, “টাঙ্গাইল শাড়ি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। সূক্ষ্ম উপস্থাপন, প্রাণবন্ত রং এবং জটিল বুননের জন্য শাড়িটি বিখ্যাত, এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রতিটি টাঙ্গাইল শাড়ি দক্ষ কারুকার্যের প্রমাণ; এটি ঐতিহ্য এবং কমনীয়তাকে একত্রিত করে।”
দেশটির সরকারি দপ্তরের এমন দাবিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশি নাগরিকরা। ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের এই ধরনের বিবৃতির সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা পোস্টটি সরিয়ে নেয় ফেসবুক থেকে।
টাঙ্গাইলের শাড়ির পরিচয় নিয়ে বিতর্কে জড়ানো এবারই প্রথম নয়। কলকাতা বিমানবন্দরে একটি বাণিজ্যিক শাড়ির উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, এটিকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ফুলিয়ায় হাতে বোনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
টাঙ্গাইলের কোথায় বানানো হয় শাড়ি
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে টাঙ্গাইল শাড়ির আনুমানিক ২০০ বছরের পথচলার ইতিহাস জানা গেছে। ঐতিহ্যবাহী এ শাড়ির সুনাম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশে।
তারা বলেন, “নদী-চর-খাল-বিল-গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন”- জেলার জীবনাচরণ ফুটে ওঠে এই দুটি লাইনে। সদর উপজেলার বাজিতপুর ও কৃষ্ণপুর, দেলদুয়ারের পাথরাইল, কালিহাতীর বল্লা, রামপুর টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ।
তবে দেলদুয়ারের পাথরাইলের খ্যাতি এ শাড়ির রাজধানী হিসেবে।
সুদীর্ঘকালের এই শিল্পের স্বীকৃতি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কারিগর এবং ব্যবসায়ীরা।
কেন এ শাড়ি শুধুই টাঙ্গাইলের
বল্লা এলাকা সুতা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোস্তফা আশরাফী ও সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান হাসান বলেন, “প্রায় আড়াইশ’ বছরের ঐতিহ্য টাঙ্গাইল শাড়ি। এ শাড়ি টাঙ্গাইলেই অসাধারণ কারুকার্য ও সুনিপুনতায় অত্যন্ত দরদ দিয়ে তৈরি করা হয়। এ শাড়ির স্বত্ব কেবলই টাঙ্গাইলের তাঁতিদের।”
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি নিয়ে ঐতিহ্যবাহী এ পণ্য স্বত্ব ছিনতাইয়ের দুঃসাহস দেখিয়েছে, বলেন ক্ষুব্ধ এই ব্যবসায়ী নেতারা।
পাথরাইলের শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, “টাঙ্গাইল শাড়ি বলতে বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে উৎপাদিত শাড়িকেই বোঝায়। জেলার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এ শাড়ি উৎপাদনে অত্যন্ত সহায়ক।”
শাড়ির মান ও কারিগরি দক্ষতার ভিন্নতায় টাঙ্গাইল শাড়ির রয়েছে হরেক প্রকারভেদ। সেসব প্রকারভেদ লিখিত বা স্বীকৃত না হলেও জেলায় উৎপাদিত শাড়ি মানেই টাঙ্গাইল শাড়ি। তবে সমমানের কারিগরি দক্ষতায় জেলার বাইরে তৈরি শাড়িকে “টাঙ্গাইল শাড়ি” বলার সুযোগ নেই বলে জানান রঘুনাথ।
“অন্য দেশের টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজের দাবি করে জিআই ট্যাগ নেওয়া- এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক।” বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়ে এর বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক ও কবি মাহমুদ কামাল বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা টাঙ্গাইল। কমপক্ষে দুইশ বছর আগে থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির সুখ্যাতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। এ শাড়ি অন্য দেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়। তাই এই পণ্যটিকে বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতির দাবি জানাই।”
পশ্চিমবঙ্গ কীভাবে এই শাড়ি নিজেদের বলে দাবি করছে
টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ আর্টিজেন্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেডের সভাপতি মোফাখখারুল বলেন, “বহুকাল ধরে টাঙ্গাইল শাড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁতিদের দক্ষতার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে।”
১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ’৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলের তাঁতিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তবে আদি পেশা “তাঁত শিল্প” ছাড়েননি তারা।
তাঁত শিল্প সংশ্লিষ্ট সংগঠনের এই শীর্ষনেতার কথায়, “তাই বলে টাঙ্গাইল শাড়ি কখনোই অন্য দেশের হতে পারে না। দীর্ঘ সময়ের প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের জোরে টাঙ্গাইল শাড়ি দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। যারা ওই দেশে আছেন তারাও শাড়ি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন, এটা যেমন সত্য, তেমনি টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইলেরই সম্পত্তি- এটাও ধ্রুব সত্য।”
স্বত্ব ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন, “টাঙ্গাইল শাড়ি, মধুপুরের আনারস ও জামুর্কির সন্দেশ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পেতে কমপক্ষে ৫০ বছরের ধারাবাহিকতার প্রমাণ দিতে হয়। অথচ টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি আড়াইশ’ বছরের পুরোনো। টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রাখে।”
২০১৭ সালে টাঙ্গাইল শাড়ি সরকারি ব্র্যান্ডিং পেয়েছে বলে জানান সরকারের এই পদস্থ কর্মকর্তা।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, “ভারত যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তারা ডকুমেন্টেশনে উল্লেখ করেছে- পাথরাইলের বসাক পরিবারের আদি পুরুষরা সেখানে গিয়ে তাঁত শাড়ির পাড়ের ডিজাইন চেঞ্জ করে একটা ভিন্ন প্রকার উদ্ভাবন করেছেন। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে স্টাডি শুরু হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আবেদন প্রক্রিয়ার বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে। এছাড়াও আপিলের সুযোগ থাকলে সে বিষয়েও কথা বলা হবে।”