নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মাকড়সা জালের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পরে দুর্দান্ত প্রতাপশালী সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদ-এসডিএস! একই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ১৯৯৬ সালে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো হয় ইসলামিক ট্রেড এন্ড কমার্স লিমিটেড-আইটিসিএল নামে। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটি গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল। তাদের প্রলোভনের কঠিন চক্করে পরে গ্রাম-শহরের মানুষ।
গ্রামের মহিলাদের ডিম বিক্রির টাকা, কৃষকের সবজি বিক্রির টাকা, শিক্ষকের পেনশন প্রাপ্তির টাকা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টাকা আমানত রাখতে শুরু করে। দুই যুগেও আমানতের টাকা ফেরত না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন এসডিএস-আইটিসিএল গ্রাহকরা।
গোপালপুর উপজেলা ভূমি অফিস সংলগ্ন নন্দনপুরে নিজস্ব জমিতে বানায় আইটিসিএল অফিস। এছাড়াও উপজেলা হেমনগরে এবং হাদিরা ইউনিয়নের মাহমুদপুরে নিজস্ব জমিতে অফিস বানানো হয়। অন্যান্য ইউনিয়নে ভাড়া অফিসে চলে তাদের কার্যক্রম।
শাখারিয়া গ্রামের নিজাম উদ্দিন বলেন, ডিপিএস ভেঙ্গে, লাখে ২হাজার টাকা লভ্যাংশের প্রতিশ্রুতিতে আইটিসিএলে সেসময় ১লাখ ২৫হাজার টাকা এককালীন রেখেছিলাম। পালিয়ে যাওয়ার পর ঢাকা হেড অফিসে যেয়েও কাউকে পাইনি। এখনো টাকা না পেয়ে হতাশ হয়েছি। ঝামেলা এড়াতে মামলা করিনি।
বাইশকাইল তালুকদারপাড়ার গৃহবধূ শাহনাজ ইসলাম জানান, নগদাশিমলা শাখার অধীনে তিনি ২টি বইয়ে সঞ্চয় জমাতেন। ডিম বিক্রির টাকায় প্রতিমাসে ২০০টাকা দিয়ে ১৬ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। এসডিএস পালিয়ে যাওয়ার খবরে সেসময় তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। জমানো টাকা ফেরৎ চান।
মাহমুদপুর গ্রামের এসএম রুহুল রুমেল জানান, আমি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়তাম, দেখেছি আমার এলাকার অনেক টাকা মেরে দিয়েছে,২০টাকা করে সঞ্চয় জমিয়ে আম্মা ৩৫০০টাকা ও আপা ৫২০০টাকা জমিয়েছিলেন। সেগুলো নিয়ে চলে গেছে।
নগদা শিমলা ইউনিয়নের লক্ষীপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শামসুর রহমান জানান, অবসরগ্রহণের পর ২০০০-০১সালে ৩ধাপে আইটিসিএলে ২লাখ টাকা রেখেছিলাম। এক বছরে দ্বিগুণ ফেরৎ দিবে বলেছিল, সব ডকুমেন্ট রয়ে গেছে। তারপর তারা উধাও হয়ে যায়। আমি আমার টাকা ফেরৎ চাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেমনগরের অফিসটি দীর্ঘদিন পুলিশের তদন্ত কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হলেও, এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। মাহমুদপুর অফিসে স্থানীয়রা মাদরাসা স্থাপন করেছে এবং গোপালপুরের আইটিসিএল এর পরিত্যক্ত অফিসে পরিচালিত হয়ে আসছিলো জামিয়া হযরত ফাতেমা তুজ জোহরা (রা:) কওমি মহিলা মাদরাসা।
মাদরাসার মোহতামিম মাওলানা আমিনুল ইসলাম জানান, একটি ভবন ছিলো বিগত সরকারের আমলে এমপি সাহেবের লোকেরা জায়গা কিনে নিয়েছে বলে ভবনটি ভেঙ্গে ফেলে, এনিয়ে মামলা হয়েছিল। ওখানে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ আছে। আবার অনুমতি নিয়ে এসেছি ছাপড়া তুলে আবার মাদরাসার কার্যক্রম শুরু করবো।
জানা যায়, এসডিএসের আমানত সংগ্রহ কার্যক্রম খুব অল্প সময়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আমানত সংগ্রহের পাশাপাশি নিজস্ব সাফা ব্যান্ডের টেলিভিশন, ঢেউটিনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালায়।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় এসডিএস ও আইটিসিএল। প্রকাশ্যে আসে টাঙ্গাইল সমাজ সেবা বিভাগ থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ ও সঞ্চয় কার্যক্রম পরিচালিত করলেও, ১৯৯৬ সালে তারা এর অঙ্গসংগঠন হিসেবে আইটিসিএল প্রতিষ্ঠা করে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালায়। ২০০২সালে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। গ্রাহকদের চাপের মুখে এক পর্যায়ে, সঞ্চয়ের হাজার কোটি টাকা ফেরৎ না দিয়েই আইটিসিএল-এসডিএস’র সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। কর্মকর্তারা সবাই গাঁ ঢাকা দেন।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ধুলবাড়ী গ্রামের মরহুম সবুর প্রামানিকের ছেলে ইসমাইল হোসেন সিরাজী তিন বন্ধু নুরুল ইসলাম, সেলিম আল দীন ও আব্দুর রহিম মিয়াকে সাথে নিয়ে সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদ (এসডিএস) প্রতিষ্ঠা করেন। এবিষয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে।