কোটা সংস্কার আন্দোলনে ও পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘর্ষ-সহিংসতায় অনেকে সারা জীবনের জন্য প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন। আহত এসব মানুষের কারও পা অথবা হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। তাঁদের অর্ধেকের বয়স ২০ বছরের কম। এ ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার অধিকাংশ মানুষ নিম্নবিত্ত পরিবারের।
তাঁদের একজন আল আমিন। আল আমিনের বয়স এখনো ১৭ বছর পার হয়নি। সে পাবনার ধোবাখোলা করোনেশন নাটিয়াবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। বড় হয়ে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন তার। তার বাবা ঢাকায় অটোরিকশা চালান, থাকেন রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়। স্কুল বন্ধ থাকায় আল আমিন ঢাকায় বাবার কাছে চলে এসেছিল। ৫ আগস্ট বিকেলে মেরুল-বাড্ডা এলাকায় বিজয় মিছিলে সেও অংশ নিয়েছিল। মিছিলের ওপর গুলি চলে। অনেকের সঙ্গে সেও গুলিবিদ্ধ হয়। জীবনের ঝুঁকি কমাতে চিকিৎসকেরা তার বাঁ পা কেটে ফেলেছেন। এখন তার চিকিৎসা চলছে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতালে)। এই কিশোরের সঙ্গে কথা হয় গত ২৪ আগস্ট। মুখে হাসি নিয়ে ঘটনার বর্ণনা করে সে। কথা বলতে বলতে হঠাৎই বিমর্ষ হয়ে পড়ে সে। আল আমিন বলে, ‘ডাক্তার হবার ইচ্ছা ছিল, মনে হয় পারব না।’ চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, ‘আমার ভাগ্যে যা হবার তা-ই হবে।’ আল আমিনসহ ওই দিন পঙ্গু হাসপাতালে ৯ জন ভর্তি ছিলেন, যাঁদের কোনো একটি পা কাটা। কারও ডান পা, কারও বাঁ পা। হাসপাতালের পরিচালকের দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১৬ জনের বাঁ পা অথবা ডান পা এবং চারজনের হাত কেটে ফেলতে হয়েছে।
যে ২০ জনের তথ্য পঙ্গু হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে রিফাত নামের বাড্ডার একজন শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মাইনুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ীর হাত কেটে ফেলতে হয়েছিল, পরে সংক্রমণ হওয়ায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি মারা যান। তালিকায় থাকা ২০ জনের মধ্যে ১০ জনের বয়স ২০ বছরের কম। ৯ জনের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। বাকি ১ জনের বয়স ৪৫ বছর। তিনি মারা গেছেন। অঙ্গ হারানো ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজন গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এর মধ্যে আছেন মামুন মিয়া, রাজু, নাদিম, আরাফাত ও মোস্তাকিন। তবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। তাঁদের মধ্যে আছে তামিম, আলী আহসান, রাইমুল ইসলাম, মেরাজুল ইসলাম, আল আমিন, ইমরান ও জুনায়েদ। মোরসালিন কাজ করতেন হোটেলে, রাকিব কাজ শেখা শুরু করেছিলেন সেলুনে, আকাশ কাজ করতেন মিষ্টির দোকানে। জাকির শিকদার, মোহাম্মদ হোসেন আহম্মদ ও আতিকুল ছোট চাকরি করতেন। দেওয়া হবে কৃত্রিম হাত-পা আহত ব্যক্তির পরিবার ও চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, প্রতিবন্ধী হয়ে পড়া ব্যক্তিদের কৃত্রিম হাত-পা দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, ‘কৃত্রিম পা লাগানো ব্যক্তি হাঁটাচলা করতে পারবেন, বসতে পারবেন। কৃত্রিম হাত লাগানো ব্যক্তি জিনিসপত্র ধরার কাজ করতে পারবেন। কিন্তু হাত দিয়ে সূক্ষ্ম কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থেকে যাবে।’
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃত্রিম হাত ও পায়ের দামে তারতম্য আছে। ২-৩ লাখ টাকা থেকে দাম ৭০-৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। কৃত্রিম হাত বা পায়ের বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রোগীদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ কৃত্রিম হাত-পা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচির প্রধান শাহীনুল হক বলেন, হাঁটুর ওপর থেকে কাটা পায়ের প্রতিটির জন্য কৃত্রিম পায়ের খরচ পড়বে ৬-৭ লাখ টাকা। আর হাঁটুর নিচ থেকে কাটা পায়ের জন্য কৃত্রিম পায়ের খরচ সাড়ে ৩ লাখ টাকা। আর কৃত্রিম হাতের জন্য খরচ পড়বে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। হাত বা পা হারানো কেউই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পারবেন না। যাঁরা কাজ করতেন, তাঁরা আর আগের মতো কাজ করতে পারবেন না। তাঁদের প্রত্যেকের মানসিক স্বাস্থ্য গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যের ওপর নির্ভরশীল থেকে তাঁদের বাকি জীবন কাটানোর ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। ছাত্র আন্দোলনে আহতদের নিয়ে একটি গবেষণার কাজ শুরু করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘অনেকের জীবন বা অঙ্গের বিনিময়ে একটি নতুন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি। যে কৃত্রিম হাত বা পা দেওয়া হবে, তা যেন হয় সর্বোচ্চ মানের, সেগুলো পেয়ে যেন মনে হয় একটি প্রতিদান তাঁরা পেয়েছেন। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসনের বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের মাথায় রাখতে হবে।’