মোঃ এরশাদ: ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট। এক মেঘলা সকাল, থেমে থেমে বৃষ্টি। সেই আবহেই ইতিহাস গড়ে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে শতাধিক শিক্ষার্থী জমায়েত হয়। তালাবদ্ধ ফটক, প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা ও হুমকি—সব উপেক্ষা করে তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল:”স্বৈরাচারী সরকারের পতন চাই, গণতন্ত্র চাই, হল খুলে দাও!”
দীর্ঘদিনের প্রতারণা, ছাত্রলীগের হুমকি ও প্রশাসনিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল শিক্ষার্থীরা। দুপুর নাগাদ শিক্ষার্থীরা একযোগে স্লোগান দিতে দিতে প্রধান ফটকের তালা ভেঙে দেয়। এ ঘটনাই সৃষ্টি করে বাংলাদেশের প্রথম ‘স্বৈরাচারবিরোধী হলমুক্ত বিদ্রোহী ক্যাম্পাস’-এর।
এই আন্দোলনের এক প্রত্যক্ষদর্শী গণিত বিভাগের মাস্টার্স শিক্ষার্থী তরফদার রোহান জানান—”১৭ জুলাই হল বন্ধ হওয়ার পর থেকেই আমরা আন্দোলনে ছিলাম। ২ আগস্ট বাইপাস রোড অবরোধ করি। ৩ আগস্ট শিক্ষার্থীরা গেটের সামনে অবস্থান নেয়। শিক্ষকদের উপস্থিতি ও বিশেষ করে আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সাহসী ভুমিকা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। স্লোগান আর উদ্দীপনায় অবশেষে আমরা তালা ভেঙে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি।”
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মরিয়ম আক্তার মীম বলেন—”কোটা আন্দোলনের সময় পোস্ট করায় ছাত্রলীগ নেতারা আমাকে হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। আমার বন্ধুদের নির্যাতন করা হয়, আমাকে পোস্ট ডিলিট করতে বাধ্য করা হয়। ১৬ আগস্ট আন্দোলন করতে চাইলে প্রশাসন ও পুলিশের বাধায় বাইপাসে অবস্থান করি এবং অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। পরদিন আমাদের হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এরপর বাসা থেকে আন্দোলনে যোগ দিই। ৩রা আগস্ট তালা ভেঙে আমরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের মাধ্যমে আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।”

ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী আক্তারুজ্জামান সাজু জানান—”১ আগস্ট ক্যাম্পাস দখলের পরিকল্পনা করি। ৩ আগস্ট গেটে উপস্থিত হয়ে প্রশাসনের তালবাহানার কারণে ২০ মিনিটের আল্টিমেটাম দিই এবং গেট ভেঙে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। এটি দেশের প্রথম হলমুক্ত বিদ্রোহী আন্দোলনের সূচনা।”
ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান এ্যাথি বলেন—”ছাত্রলীগ ও সরকারি দলের লোকজন রাস্তায় টহল দিচ্ছিল। রিকশা না পেয়ে কষ্ট করে গেটে আসি। ছোট মনিরের লোকজন বাধা দেয়। কিন্তু আমরা গেটের সামনে অবস্থান নিই। শিক্ষকরা আমাদের সঙ্গে থাকেন। পরে তালা ভেঙে প্রবেশ করি এবং ছাত্রলীগের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলি।”
রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাইমুর রহমান দূর্জয় জানান—”১৭ জুলাই হল ত্যাগের নির্দেশনার পরই আন্দোলন শুরু হয়। পুলিশ ও প্রশাসনের নির্যাতন সত্ত্বেও ৩ আগস্ট আমরা গেট ভেঙে প্রবেশ করি এবং প্রক্টরের কাছে হল খোলার স্মারকলিপি দিই।”
মাভাবিপ্রবির এই আন্দোলন ছিল নিছক কোনো ছাত্র আন্দোলন নয়, এটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রতীক।
এটি ছিল স্বাধীনতার এক নতুন প্রকাশ, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হয়েছে।
“যদি আবার কখনো স্বৈরাচার মাথা তুলে দাঁড়ায়, আমরা রাজপথে নামব”— এই অঙ্গীকারে শিক্ষার্থীরা গড়েছে একটি সাহসী ঐতিহাসিক স্মৃতি।