জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। চাইলেও ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বকেয়া বাড়তে থাকায় তেলের জাহাজ পাঠাতে চাইছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। নির্ধারিত সময়ের পর আসছে কোনো কোনো জাহাজ। বিল পরিশোধে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর চাপ বাড়ছে বিপিসির ওপর।বিপিসি সূত্র বলছে, ২২ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৪৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার বকেয়া জমেছে বিপিসির। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ভিটলের, তারা পাবে ১৮ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। সোনালী ব্যাংক থেকে তাদের একটি বিল পরিশোধে ইতিমধ্যে ১১০ দিন বিলম্ব হয়েছে। ৯৪ দিন, ৮৫ দিন বিলম্ব হওয়া বিলও আছে কোনো কোনো সংস্থার।
বিপিসির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চুক্তি অনুসারে বিলম্বের জন্য বছরে এখন সাড়ে ৬ শতাংশ হাতে অর্থ মাশুল হিসেবে দিতে হবে। যদিও দীর্ঘ ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে বিলম্ব মাশুলের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো চাপ দেয়নি। তবে দ্রুত বিল পরিশোধে তাগাদা দিচ্ছে নিয়মিত। দফায় দফায় বৈঠক করে তাদের দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি বুঝিয়ে কিছুটা সময় চাওয়া হয়েছে। মাঝে ব্যাংক বন্ধ থাকায় দেরি হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। চীনের কোম্পানি ইউনিপেক পাবে প্রায় ৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। আরব আমিরাতের ইনক পাবে ৫ কোটি ৭১ লাখ ডলার। ইন্দোনেশিয়ার বিএসপি পাবে ৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। মালয়েশিয়ার পিটিএলসিএল পাবে ২ কোটি ১৮ লাখ ডলার। আর ভারতের আইওসিএল পাবে আড়াই কোটি ডলার। এর বাইরে বকেয়া কিস্তি জমেছে বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও। জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য পরিশোধে বিপিসিকে নিয়মিত ঋণসহায়তা দেয় ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি)। তারা পাবে ৮ কোটি ডলারের বেশি। জ্বালানি তেল বিক্রি করে দুই বছরের বেশি সময় ধরে মুনাফা করছে বিপিসি। গত মার্চ থেকেই প্রতি মাসে মূল্য সমন্বয় করছে তারা। তাই সংস্থাটির আর লোকসানে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু বিদেশি দেনা পরিশোধে ডলার জোগাড়ে আড়াই বছর ধরেই সমস্যার মধ্যে আছে তারা। এর মধ্যে গত মাস জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পরিবর্তন ঘিরে ব্যাংক বন্ধ ছিল বেশ কয়েক দিন। এতে আরও সমস্যায় পড়েছে বিপিসি। বকেয়া পরিশোধের পাশাপাশি ঋণপত্র খুলতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিপিসি সূত্র বলছে, প্রতি মাসে ৫ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল ও ১ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আনতে ১৭ থেকে ১৮টি ঋণপত্র খোলার দরকার হয় বিপিসির। ডলারে ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকগুলো নিয়মিত গড়িমসি করে। একটি ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মাঝেমধ্যে ২ কোটি ডলার করে ছাড় করলেও তা দিয়ে বকেয়া পুরোপুরি পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
বছরে বিপিসির ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল লাগে। এর মধ্যে দেশের একমাত্র পরিশোধনাগারের সক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ টন। বাকিটা সরাসরি আমদানি করা হয়। তবে দেশে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের মধ্যে ৭৫ শতাংশই ডিজেল। আর ডিজেলের ৮০ শতাংশ সরাসরি আমদানি করা হয়। জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিচ্ছে বিপিসির কাছে তেল বিক্রি করা বিদেশি সংস্থাগুলো। বিপিসির পরিচালক (অপারেশন) অনুপম বড়ুয়া বলেন, সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করা হচ্ছে। একটা বিশেষ পরিস্থিতির কারণে দেনা পরিশোধে দেরি হওয়ার বিষয়টি তাদের বোঝানো হয়েছে। ধীরে ধীরে তাদের বিল পরিশোধ করার কথাও বলা হয়েছে। দীর্ঘ ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে তারা তেল সরবরাহ বন্ধ করবে না। তবে জ্বালানি তেলের মজুত পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। ২২ আগস্ট পর্যন্ত ডিজেলের মজুত আছে ৪ লাখ ২৬ হাজার টন। তা দিয়ে দেশের অন্তত ৩৫ দিনের চাহিদা মেটানো যাবে। পেট্রলের মজুত আছে প্রায় ২৩ হাজার টন, যা দিয়ে ১৮ দিন চলবে। অকটেন আছে ৩৩ হাজার ২২৮ টন, যা ২৫ দিনের চাহিদার সমপরিমাণ মজুত। যদিও পেট্রল ও অকটেনের একটি বড় অংশ দেশে উৎপাদিত হয়। তাই এ নিয়ে অতটা অনিশ্চয়তা নেই। উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল আছে ৪০ হাজার ২৫ টন, যা দিয়ে ২৬ দিনের চাহিদা মেটানো যাবে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস তেল আছে ৩৩ হাজার ৪৫২ টন। এ পরিমাণ তেল দিয়ে ১২ দিন চলার কথা। বিদ্যুৎকেন্দ্রে এখন তেলের চাহিদা আছে। কিন্তু অধিকাংশ সরবরাহকারী ফার্নেস তেল দিতে রাজি হচ্ছে না। ৩০ আগস্টের মধ্যে ফার্নেস তেল নিয়ে একটি জাহাজ আসার কথা রয়েছে। এটি পিছিয়ে গেলে সংকট তৈরি হতে পারে। সচিবালয়ে গত বুধবার বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানি বিল ২২০ কোটি ডলার বকেয়া পড়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে বকেয়া পরিশোধে ১০০ কোটি ডলার প্রদানের জন্য বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ করেন তিনি। আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেলে তা বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বকেয়া পরিশোধে গত বৃহস্পতিবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তা চেয়েছেন জ্বালানি উপদেষ্টা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, বিল বকেয়ার এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এটা টাকার সমস্যা নয়, অভাব ডলারের। সমস্যাটি থেকে ধাপে ধাপে বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে এমন অবস্থা চালিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নতুন সরকার জ্বালানি খাতের বকেয়া পরিশোধে যে ডলার চেয়েছে, তা পেলে সমস্যা অনেকটা কাটবে।