দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম মঞ্চে ওঠেন আবুল হায়াত। এরপর ৬০ বছরের বেশি সময়ের পুরোটাই নাটকে কাটিয়েছেন, তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে অভিনয়। অভিনয়ের পাশাপাশি সমানতালে নির্মাণ, লেখালেখিও করে চলছেন তিনি। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর তাঁর ৮০তম জন্মদিন। দিনটি সামনে রেখে শেষ করেছেন আত্মজীবনী লেখার কাজ। প্রচ্ছদ আঁকা ও প্রকাশনার প্রস্তুতি চলছে এখন। গতকাল শুক্রবার বিকেলে কথা প্রসঙ্গে এমনটাই জানালেন আবুল হায়াত।
১৯৪৭ সালের কথা। মুর্শিদাবাদের একটি গ্রামের আলপথ। দুই পাশে ধানখেত।
কয়েকটি পালকিতে চড়ে যাচ্ছেন একটি পরিবারের সদস্যরা। তারপর ট্রেনে চেপে তাঁরা চলে আসেন এই বাংলায়, চট্টগ্রামে। সংস্কৃতিমনা বাবার সান্নিধ্যে চার বছর বয়সী রবির (আবুল হায়াতের ডাকনাম) মনে গেঁথে যায় নাটক। মঞ্চে অমলেন্দু বিশ্বাসের নাটক দেখে ঠিক করেন, এটাই করবেন। তা-ই করলেন সারা জীবন। এবার ৮০ বছরে জীবনের ভ্রমণটা একমলাটে পাওয়া যাবে। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে আত্মজীবনীর নাম ‘রবি পথ’ দিয়েছেন। সংগীতানুরাগী বাবা আবদুস সালাম ছিলেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মিল রেখে বাবা তাঁকে ‘রবি’ নামে ডাকতেন। বাবা ছিলেন সব্যসাচী, ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। কাগজ থেকে ছবি বানাতে পারতেন। ছেলের প্রথম নাটক দেখে বাবা বলেছিলেন, তাঁর নাকি মনে হয়নি, আবুল হায়াত অভিনয় করেছেন। স্কুলজীবন কেটেছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট ও রেলওয়ে উচ্চবিদ্যালয়ে।
লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন আবুল হায়াত। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ১৯৬২ সালে বুয়েটে ভর্তি হন। বুয়েটে পড়ার সময় শেরেবাংলা হলে থাকতেন। এরপর বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ১৯৬৭ সালে পাস করে ১৯৬৮ সালেই ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। বুয়েটে পুরকৌশলে পড়াশোনা শেষ করে প্রথমে ওয়াসা, পরে আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শক হিসেবে তিনি লিবিয়া ও লাওসে দীর্ঘদিন কাজ করেন। ‘রবি পথ’ বইয়ে এসব সময়ের একটা প্রতিফলন থাকবে, এমনটাই জানালেন। ‘রবি পথ’ বইয়ে কী কী থাকছে, জানতে চাইলে আবুল হায়াত বললেন, ‘জন্ম থেকে এই পর্যন্ত যেগুলো আমার মনে হয়েছে বলা দরকার, বলেছি। আবার অনেক কথা হয়তো বলা দরকার ছিল, বলা হয়নি। হয় কি, লিখতে গেলে বোঝা যায়, কোনটা লেখা দরকার, আবার অনেক কিছু মনে হয় না লিখলেই ভালো। যা–ই হোক, আশা করছি, সবকিছু মিলিয়ে আমার পুরো যাত্রাপথ জানা যাবে।’ বলছিলেন ৮০ বছরের যাত্রাপথের অনেক কিছু আত্মজীবনীতে লিখতে পারেননি, কেন? এমন প্রশ্নে আবুল হায়াত বলেন, ‘আসলে এটা হয় না। সীমাবদ্ধতা তো অনেক রকম আছে। কিছু কথা লিখেছি, পরে মনে হয়েছে, এ কথাগুলো না লিখলেও চলত। তবে আমার মনে হয়, খোলামনে যা এসেছে, সবই লিখে গেছি।’ আত্মজীবনী ‘রবি পথ’ ৩০০ পৃষ্ঠার বেশি বলে জানালেন আবুল হায়াত। বেশ কয়েকটি গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। আত্মজীবনী কেন অন্য সব বইয়ের চেয়ে আলাদা? আবুল হায়াত বললেন, ‘এটা আমাকে নিয়েই লেখা। কোনো গল্প নয়, উপন্যাস নয়। নিজের জীবনের কথা লিখেছি। অনেকে উৎসাহী আমার কথা জানতে, অনেকে এমনটা বলে উৎসাহও প্রকাশ করেছে। আমার নিজেরও মনে হয়েছে, উত্তরপুরুষ যারা আসবে, আমার নাতি-নাতনি যারা এখনো অনেক কিছু জানে না, তাদেরও বংশধর হয়তো এক সময়…যদিও আই অ্যাম নট ভেরি ইমপর্ট্যান্ট পারসন, বাট ইভেন দ্যান তাদের কাছে তো আমি একজন ইম্পর্ট্যান্ট পারসন। হয়তো অনেকে এ–ও ভাবতে পারেন, তিনি কী এমন মানুষ যে তাঁর আত্মজীবনী পড়ব। আমার মেয়েরা, তাদের স্বামী, নাতি-নাতনি, বংশধরেরা হয়তো পড়ে আগ্রহ বোধ করবে।’
কথা প্রসঙ্গে আবুল হায়াত বলেন, ‘এখন আমার মনে হয় যে আব্বার জীবনীটা পুরোপুরি জানি না। তিনি যদি লিখে যেতেন, তাহলে জানতে পারলে ভালোই হতো। তারপর অনেক সময় কথাবার্তা বলে কিছুটা জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি। তা ছাড়া আমরা তো আসলে আব্বাদের সঙ্গে অতটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। সেই সময় পরিবেশ তো অন্য রকম ছিল, এখনকার মতো নয়। তাই অজানা রয়ে গেছে অনেক কিছু।’ কত দিন ধরে লিখেছেন রবি পথ? ‘১০ বছর ধরে। আমি আসলে খুবই অলস প্রকৃতির লোক। লিখি, ফেলে রাখি। দেখা গেল, কোনো দিন এক চ্যাপ্টার লিখেছি, কোনো দিন এক পৃষ্ঠা, দুই লাইন, তারপর বহুদিন পড়ে ছিল। এরপর আমার মেয়ে বিপাশা বলল, “বাবা তুমি লেখো না কেন?” আমি বিপাশাকে বললাম, লিখে কী হবে? আমার লেখা তো কোনো ক্ল্যাসিক কিছু হবে না। সে বলে, “ওই সব বোলো না। তোমার লেখা তোমার কাছে শ্রেষ্ঠ লেখা। তোমার জীবনী তোমার চেয়ে ভালো তো কেউ লিখতে পারবেও না। তাই তুমিই লিখবে। মনের তাগিদ থেকে লিখবে। যার ভালো লাগবে না, সে পড়বে না। যার ভালো লাগবে, পড়বে, পাশে রেখে দেবে।” এরপর আমি উৎসাহ বোধ করলাম যে ঠিক আছে, আচ্ছা। অনেকে উৎসাহিত হতেও পারে। সে হিসেবে বলা যায়, অনুপ্রেরণা আমার বড় মেয়ে। তৌকীরও উৎসাহ দিয়েছে। সে বলত, “আপনি লেখেন। যা মনে আসে, লেখেন।” কিছুদিন পরপর জিজ্ঞেস করত, “কত দূর হলো লেখা?” এ বছর তো আমাকে বলেছিল, “আপনার জন্মদিনে যেন অবশ্যই আত্মজীবনী পাই।” আমি ভাবলাম, এবার যদি লেখা শেষ করতে না পারি, তাহলে আর হবে না।’
আত্মজীবনী ‘রবি পথ’ প্রকাশিত হবে সুবর্ণ থেকে, এটি আবুল হায়াতের ছোট মেয়ে নাতাশার বান্ধবীর প্রকাশনা সংস্থা। বললেন, ‘মেয়ে নাতাশার বান্ধবী তাদের প্রকাশনা সংস্থা থেকে বইটি প্রকাশে আগ্রহী হয়। তবে বইটি আদৌ প্রকাশিত হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় ছিল। এটা ঠিক, লেখাটা শেষ করতে চেয়েছি। ছাপা নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম না। নাতাশার বান্ধবীর উৎসাহে সিরিয়াস হই। সে–ও বলল, “আপনি লিখে ফেলেন আঙ্কেল, জন্মদিনে হয়তো প্রকাশ করতে পারব না, তবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করব।”’ ‘রবি পথ’–এর প্রচ্ছদ করছেন আবুল হায়াতের বড় মেয়ে জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী ও চিত্রকর বিপাশা হায়াত। এখন পরিবার নিয়ে বিপাশা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। বাবার আত্মজীবনীর প্রচ্ছদ মেয়ে আঁকছেন, এটাও দারুণ আনন্দের বলে জানালেন আবুল হায়াত। আত্মজীবনী নিয়ে সবশেষে আবুল হায়াত বললেন, ‘নিজের ভেতর একটা চাহিদা থাকে যে এই জীবনে আমি কী করলাম না করলাম। ভেতর থেকে একটা আকাঙ্ক্ষা আসে। আমার এটা ডায়েরি লেখার মতোই। এটা শুধু লেখার জন্যই লেখা, শুরু করেছিলাম ওইভাবে। শুরুতে মাথার মধ্যে একটা চিত্রকল্প এঁকেছিলাম।’