স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হাঁটাকে সবচেয়ে সহজ ও সবার জন্য সহজলভ্য ব্যায়াম হিসেবে সুপারিশ করেন। কিন্তু কেন? কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত হাঁটার অনেক শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা রয়েছে। এটি হৃদযন্ত্রের সুস্থতা বাড়ায়, মেজাজ ভালো রাখে, শরীরকে প্রাণবন্ত করে তোলে, মানসিক চাপ কমায় এবং উদ্বেগ দূর করে। এমনকি ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার ঝুঁকিও কমায়।
তবুও অনেকেই হাঁটেন ‘অটোপাইলট’ মোডে, অর্থাৎ ভঙ্গি, শরীরের সঠিক অবস্থান বা হাঁটার গুণগত মান নিয়ে ভাবেন না। এর ফলে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভুলভাবে হাঁটার অভ্যাস পেশির ভারসাম্য নষ্ট করে, জয়েন্ট শক্ত করে এবং এমন শারীরিক প্যাটার্ন তৈরি করে যা ব্যথা ও অস্বস্তির কারণ হয়।
কিন্তু আপনি যদি হাঁটার সময় সচেতন হন, শ্বাস-প্রশ্বাস ও শরীরের সঠিক অবস্থানে মনোযোগ দেন, তাহলে যেকোনো হাঁটাকে পুরো শরীরের জন্য ‘টিউন আপ’ বানানো সম্ভব। নিচে জানুন কীভাবে প্রতিটি পদক্ষেপ আরও ভালো করা যায়।
হাঁটার ধরন বুঝুন ভালোভাবে হাঁটার প্রথম ধাপ হলো এটিকে একটি সমন্বিত শরীরচর্চা হিসেবে দেখা। হাঁটা মানে শুধু এক পা অন্য পায়ের সামনে ফেলা নয়, এটি শরীরের নানা পেশি ও অঙ্গের সমন্বিত কাজ। আপনার পা কিভাবে মাটিতে পড়ছে, গ্লুট পেশি কতটা সক্রিয়, কোমরের পেশি কীভাবে কাজ করছে, হাতের দোল কেমন হচ্ছে—এসব গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক হাঁটায় গোড়ালি থেকে আঙুল পর্যন্ত ধাপে ধাপে পা ফেলা হয়, যা সামনের দিকে গতি নিয়ে আসে এবং পায়ের পেছনের পেশি ও গ্লুট পেশিকে সক্রিয় করে। কোর পেশি পেলভিস ও মেরুদণ্ডকে স্থিতিশীল রাখে। পাঁজরের খাঁচা ও নিতম্ব সামান্য ঘোরে, বিপরীত হাত-পায়ের দোলের সঙ্গে মিল রেখে। এর ফলে শরীর দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে চলে এবং শক্তি ও ওজন সঠিকভাবে ভাগ হয়।
আপনি কি ঠিকভাবে হাঁটছেন? দুটি সহজ উপায়ে যাচাই করতে পারেন— প্রথমত জুতার তলার ক্ষয় দেখুন। সাধারণত গোড়ালি ও সামনের অংশে সমান ক্ষয় হওয়া উচিত। একপাশে বেশি ক্ষয় হলে বুঝতে হবে হাঁটার ভারসাম্যে সমস্যা আছে। অন্যদিকে, পরিবারের কেউ বা বন্ধু দিয়ে পাশ থেকে ও পেছন থেকে ভিডিও করান। স্বাভাবিক গতিতে হাঁটুন এবং নিজের ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করুন।
হাঁটার ভুল হলে কী সমস্যা হয়? ভুলভাবে হাঁটলে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। যেমন— ছোট ছোট বা টেনে হাঁটা গ্লুট পেশিকে নিষ্ক্রিয় করে। ‘ডাক ওয়াক’ (পা ও নিতম্ব বাইরে ঘোরানো) ও ‘পিজন-টো’ (পা ও নিতম্ব ভেতরে ঘোরানো) ভঙ্গি গ্লুট সক্রিয়তা কমিয়ে দেয় ও ভঙ্গি নষ্ট করে। হাতের কম দোল ঘাড়, কাঁধ ও পিঠে টান দেয়। কুঁজো ভঙ্গি বা মাথা সামনের দিকে নিচু করে হাঁটা শরীরের সঠিক সুষমি নষ্ট করে। এক কাঁধে ব্যাগ রাখা বা এক হাতে কুকুরের লিশ ধরলে শরীরে অসম ভারসাম্য তৈরি হয়। বুক দিয়ে অগভীর শ্বাস নেওয়া পাঁজরের গতি কমায় ও কোর দুর্বল করে।
হাঁটার জন্য সহজ টিউন-আপ চেকলিস্ট জয়েন্ট অ্যালাইনমেন্ট: কাঁধ ও নিতম্ব সোজা রাখুন, মেরুদণ্ড মাথা থেকে পেলভিস পর্যন্ত সোজা রেখেই হাঁটুন। মাথা সামনের দিকে ঠেলে দেবেন না বা কোমর অতিরিক্ত ঢালাবেন না।
ফুট স্ট্রাইক: গোড়ালি বা পায়ের মাঝখানে নরমভাবে পা রাখুন, তারপর আঙুল পর্যন্ত ধীরে ধীরে চাপ দিন। পা সামনের দিকে সোজা রাখার চেষ্টা করুন। ওজনের ভারসাম্য: দুই পায়ের মধ্যে শক্তি সমান ভাগ করুন, গ্লুট পেশি সক্রিয় রাখুন। গ্লুট ব্যবহার করুন: প্রতিটি পা চালানো নিতম্বের পিছন থেকে শুরু হচ্ছে ভাবুন এবং পা ছাড়ার সময় গ্লুট পেশির কাজ অনুভব করুন।
হাতের নড়াচড়া: হাতগুলো পায়ের বিপরীতে স্বাভাবিকভাবে দোলান। কনুই নরম রাখুন। ব্যাগ বা পোষা প্রাণীর লিশ থাকলে মাঝে মাঝে হাত বদলান। দৃষ্টি: মাটির দিকে নয়, সামনে তাকান। ফোন দেখবেন না। এতে ভঙ্গি সঠিক থাকে ও দৃষ্টি উন্নত হয়। সচেতন থাকুন: চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকুন। শ্বাস-প্রশ্বাস, ভঙ্গি ও শরীরের অনুভূতি বুঝে হাঁটুন। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ: শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি মনোযোগ দিন এবং এটি যেন আপনার গতি ও ভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করে।
হাঁটার গতি নিয়ন্ত্রণে শ্বাসপ্রশ্বাসের ভূমিকা অধিকাংশ মানুষ হাঁটার সময় শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতি খেয়াল দেয় না, অথচ শ্বাসপ্রশ্বাসের ধরন হাঁটার ভঙ্গি ও শক্তি নিয়ন্ত্রণে বড় প্রভাব ফেলে। বুক দিয়ে অগভীর শ্বাস নেয়া ভঙ্গি খারাপ করে এবং চাপ বাড়ায়। হাঁটার সময় ছন্দময় নাসারন্ধ্র শ্বাস নিন চার পদক্ষেপ শ্বাস নিন এবং ছয় পদক্ষেপ শ্বাস ছাড়ুন। এটা স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত রাখে এবং শরীরকে সঠিক অবস্থানে রাখতে সাহায্য করে।
হাঁটার আগে কিছু প্রস্তুতি নিন হাঁটার আগে মোবিলিটি এক্সারসাইজ করলে পেশি প্রস্তুত হয়, জয়েন্টের গতি বাড়ে এবং টান কমে। নিচের তিনটি ব্যায়াম করুন:
১. প্রতি পাশে পাঁচবার করে গোড়ালি বৃত্ত করুন।
২. প্রতি পাশে পাঁচবার স্টেপ-ব্যাক লঞ্জ করুন।
৩. শেষ করুন উইন্ডমিল টুইস্ট দিয়ে, যা পায়ের পেছনের পেশি শিথিল করে, কোমর সোজা করে এবং বুক ও কাঁধ খুলে দেয়। হাঁটা শুধু হার্টের ব্যায়াম নয়, এটি শরীর ও মনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যায়াম। সচেতনভাবে হাঁটা, শ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ ও সঠিক ভঙ্গি আপনার দৈনন্দিন হাঁটাকে স্বাস্থ্য ও সুস্থতার শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত করবে।