সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে এসে গ্রেফতার এড়াতে কৌশল অবলম্বন করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ কারণেই চলমান হরতাল-অবরোধে রাজপথ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন অনেকে। তবে সাময়িক গাঢাকা দেওয়া নেতারা তফসিলকেন্দ্রিক আন্দোলনে মাঠে নামবেন। মূলত গ্রেফতার এড়িয়ে আন্দোলন একটা পর্যায়ে নিতেই বিএনপির এ নীতি বলে জানা গেছে। আর তফসিলের পরদিন ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের ঘোষণা নিয়ে আলোচনা চলছে বলেও জানিয়েছে একটি সূত্র। দলটির নেতারা বলছেন, সামনে আন্দোলন জোরদার হবে। তখন সম্মিলিতভাবে নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যাবে।
জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের পর পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। সংঘর্ষে একজন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হওয়ার ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীদের নামে মামলা হওয়ার পর কয়েকজন গ্রেফতার হন এবং অধিকাংশ চলে যান আত্মগোপনে। নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতিতে দীর্ঘদিনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হলেও সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর বিএনপি হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে রয়েছে। মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পরদিন গত ২৯ অক্টোবর দলটির পক্ষ থেকে হরতালের ডাক দেওয়া হয়।
‘যেসব নেতাকে মাঠে দেখা যাচ্ছে না, তারা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দলের নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। অবশ্যই তারা মাঠে নামবেন। তিনি বলেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নানা কৌশল থাকে। অনেকেই কৌশলী অবস্থানে আছেন।’- বিএনপি নেতা আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল
প্রথমেই গ্রেফতার হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস-চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক ও মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপনসহ দলটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা।
এছাড়া গত কয়েকদিনে সারাদেশে আট হাজারের বেশি বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন বলে দাবি দলটির। এমন পরিস্থিতিতে গ্রেফতার এড়িয়ে আন্দোলন জোরদারে কৌশলী বিএনপি।
সূত্র মতে, দলটির সব পর্যায়ের নেতাদের তফসিলের আগ পর্যন্ত গ্রেফতার এড়িয়ে চলার নির্দেশনা রয়েছে। তাই, চলমান হরতাল-অবরোধে নেতাকর্মীরা মাঠে কম থাকলেও তফসিল ঘোষণার পর তারা মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তফসিলের আগে ও পরে কর্মসূচি নির্ধারণে দলটির হাইকমান্ড নিজ দলের পাশাপাশি সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে মতামত নিচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলকে তফসিল ঘোষণাকেন্দ্রিক আন্দোলনে পাশে পেতে তৎপরতা চালাচ্ছে বিএনপি।
বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, বিগত দিনে ডিএমপির অনুমতি সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করলেও বর্তমানে তা দুরূহ ব্যাপার। ডিএমপিকে চ্যালেঞ্জ করে কর্মসূচি পালনে এক্সপেরিমেন্ট করতেই ২৮ অক্টোবর পরবর্তী কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। কারণ চলমান আন্দোলন দীর্ঘায়িত হতে পারে সেই বিবেচনায় এ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। যে কারণে নভেম্বরের প্রথম দশদিনের হরতাল অবরোধ কর্মসূচিতে রাজপথে দেখা মেলেনি নেতাকর্মীদের। কেননা একই সময় সবাই গ্রেফতার বা কর্মসূচি পালনে শক্তি হারানোর পক্ষে নয়। তবে, প্রত্যেক নেতা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দলের জন্য কাজ করছেন।
নেতাদের ধারণা, ১৪ নভেম্বর বা তার কাছাকাছি সময়ে তফসিল ঘোষণা হতে করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) নির্বাচন কমিশনাররা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন। রাষ্ট্রপতি তফসিল ঘোষণার জন্য সম্মতি দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন সিইসি। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার। তফসিলকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের গতি বাড়াতে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে দলটি।
তফসিল ঘোষণা পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ জেলের বাইরে থাকা সিনিয়র নেতারা— দলের কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলা এমনকি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের নেতাদের পরামর্শ নিচ্ছেন। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, সমমনা জোট, এলডিপি ও গণঅধিকার পরিষদসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে কথা হয়েছে বিএনপির হাইকমান্ডের। পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামী দলকে তফসিলকেন্দ্রিক আন্দোলনে পাশে চায় বিএনপি। এ বিষয়ে কাজ করছেন বিএনপি নেতারা।
তবে এবার কর্মসূচির ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে। তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিএনপিতে নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে। সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইসির আওতায় থাকবে। তবে, তফসিল ঘোষণার মুহূর্ত থেকেই মাঠে নামতে প্রস্তুত বিএনপি। তফসিলের পরদিন ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের ঘোষণা দিতে পারে বিএনপি। এছাড়া সচিবালয় ঘেরাও, ইসি ঘেরাও কর্মসূচি আছে আলোচনায়। পাশাপাশি জেলা ও উপজেলায় হরতাল-অবরোধ পালনে কঠোর নির্দেশনা দেবে দলটি। সারাদেশ থেকে রাজধানী বিচ্ছিন্ন করতে সবধরনের পদক্ষেপ নেবে বিএনপি। ঘরে বসে গ্রেফতার না হয়ে তখন রাজপথে গ্রেফতার হওয়ার ব্যাপারেও নির্দেশনা আসবে দলের হাইকমান্ডের। এছাড়া বড় শোডাউন দেওয়ার পরিকল্পনা নিতে পারে তারা।
২৮ অক্টোবর পরবর্তী হরতাল-অবরোধ পালনে ঢাকার রাজপথে নিয়মিত ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিচ্ছেন ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মতিউর রহমান।
দেশের মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে বিএনপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যে কোনো পরিস্থিতিতে আমরা মাঠ ছাড়বো না। যে কোনো মুহূর্তে রাজপথে শুধু নেতাকর্মীরাই নন, জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার দেখা যাবে। জনতার স্রোতে ভোটের অধিকার ফিরে আসবে। জনতার বিজয় সুনিশ্চিত।- বিএনপি নেতা মতিউর রহমান।
মতিউর রহমান বলেন, দেশের মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে বিএনপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যে কোনো পরিস্থিতিতে আমরা মাঠ ছাড়বো না। যে কোনো মুহূর্তে রাজপথে শুধু নেতাকর্মীরাই নন, জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার দেখা যাবে। জনতার স্রোতে ভোটের অধিকার ফিরে আসবে। জনতার বিজয় সুনিশ্চিত।
রাজপথের মিছিলে থাকা বিএনপির সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল বলেন, যেসব নেতাকে মাঠে দেখা যাচ্ছে না, তারা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দলের নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। অবশ্যই তারা মাঠে নামবেন। তিনি বলেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নানা কৌশল থাকে। অনেকেই কৌশলী অবস্থানে আছেন।
পাতানো নির্বাচন দেশের মানুষ মেনে নেবে না জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, পুলিশি নির্যাতন-বাধা উপেক্ষা করে গ্রেফতার এড়িয়ে আন্দোলন করছে বিএনপি। যে কোনো সময় আন্দোলনের ধরন পরিবর্তন হবে, গতি বাড়বে। অন্যদিকে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকারকে দাবি মানাতে যা কিছু করার দরকার দেশের মানুষ তাই করবে। যারা ভাবছেন গ্রেফতার করে আন্দোলন দমানো যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।