টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ: বাংলাদেশের মানচিত্রে টাঙ্গাইল জেলা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এক অনন্য মিশেলে গড়ে উঠেছে। গত এক দশকে এ জেলার উন্নয়ন গতিধারা উল্লেখযোগ্য হলেও কিছু ক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে থাকার চিত্রও বিদ্যমান। স্থানীয় প্রশাসন, সরকারি উদ্যোগ এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টাঙ্গাইলের উন্নয়নকে কীভাবে বহুমাত্রিক করে তোলা যায়— তা নিয়ে চলছে নানা পরিকল্পনা ও আলোচনা।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন: সড়ক থেকে সেতু,
টাঙ্গাইলের উন্নয়নের সবচেয়ে দৃশ্যমান দিক হলো যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চার লেন সম্প্রসারণ এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ এ অঞ্চলের যানজট কমিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি এনেছে। এ ছাড়া, যমুনা সেতুর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ টাঙ্গাইলকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করেছে। তবে গ্রামীণ এলাকায় এখনও অনেক সংযোগ সড়ক কাঁচা বা সংস্কারবিহীন, যা বর্ষায় দুর্গম হয়ে ওঠে।
কৃষি ও শিল্পের সমন্বয়,
টাঙ্গাইল ঐতিহ্যগতভাবে কৃষিনির্ভর জেলা। ধান, পাট, আখ এবং মৌসুমি ফলের উৎপাদনে এ জেলা দেশের শীর্ষস্থানীয়। বর্তমানে সরকারের কৃষি প্রণোদনা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি, টাঙ্গাইলের শিল্পখাতেও পরিবর্তন আসছে। মির্জাপুরে গড়ে উঠেছে “যমুনা ইকোনমিক জোন”, যা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখছে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব এখনও চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: অগ্রগতি ও ঘাটতি,
শিক্ষাখাতে টাঙ্গাইলের অগ্রগতি লক্ষণীয়। জেলায় সরকারি কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি, ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন এবং বিনামূল্যে বই বিতরণের ফলে শিক্ষার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২% (বিবিএস ২০২৩)। তবে উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, জেলা সদর হাসপাতাল আধুনিকায়ন হলেও প্রত্যন্ত এলাকায় চিকিৎসক ও ওষুধের অভাব প্রকট।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পর্যটন,
টাঙ্গাইল তার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। প্রতিবছর মহাষ্টমীর মেলা, বাউল সম্মেলন এবং লোকশিল্পের প্রদর্শনী হাজারো পর্যটককে আকর্ষণ করে। এ ছাড়া, মধুপুর গড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং আটিয়া মসজিদের ঐতিহাসিক নিদর্শন পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকে বাড়িয়েছে। তবে পর্যটন সুবিধা বাড়াতে হোটেল ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথ,
টাঙ্গাইলের উন্নয়নের প্রধান বাধা হলো নগরায়নের চাপে পরিবেশগত ক্ষতি, যুবসমাজের কর্মসংস্থানের অভাব এবং নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের সীমিত সুযোগ। এ সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজন:
১. গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে বাজেট বাড়ানো।
২. কারিগরি শিক্ষার প্রসার ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য মাইক্রো-ক্রেডিট সুবিধা।
৩. পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন এবং পর্যটন খাতের আধুনিকীকরণ।
উপসংহার:
টাঙ্গাইল জেলার উন্নয়ন কেবল স্থানীয় নয়, জাতীয় অগ্রগতিরও অংশ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, যুবশক্তির সম্পৃক্ততা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে টাঙ্গাইল আগামী দিনে বাংলাদেশের উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে।
প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত মন্তব্য:
“টাঙ্গাইলের মানুষ তাদের পরিশ্রম ও সৃজনশীলতায় উন্নয়নের পথে হাঁটছে। তবে সমৃদ্ধির জন্য আমাদের আরও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা এবং সামাজিক সমতার দিকে নজর দিতে হবে।”