***একান্ত সাক্ষাতকার***
রাজনীতি শব্দটি অনেকের কাছে ক্ষমতা, পদ-পদবি কিংবা সুবিধার প্রতীক। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, যাদের কাছে রাজনীতি মানে ত্যাগ, সংগ্রাম আর মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করার প্রেরণা। এমনই একজন মানুষ অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল। টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, আইনজীবী, সাবেক ছাত্রনেতা ও সবচেয়ে বড় পরিচয়- জনগণের আপনজন। বিশেষ করে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের প্রত্যন্ত চরাঞ্চল থেকে শহরের কেন্দ্রস্থল- সবখানেই পরিচিত মুখ, জনপ্রিয় নেতা, নির্যাতিত সংগ্রামী কর্মী অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল। বিশেষ করে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের মানুষজন যাকে ভালোবাসেন হৃদয়ের গভীর থেকে। যায়যায়দিনের
সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে এসেছে এক সংগ্রামী নেতার ত্যাগ, প্রত্যয় ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার গল্প- যা আজকের তরুণদের জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার প্রতীক। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ ও গ্রন্থণা করেছেন আমাদের টাঙ্গাইলের স্টাফ রিপোর্টার মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল।
যাযাদি: আপনার রাজনীতির শুরুটা কেমন ছিল?
ফরহাদ ইকবাল (হেসে): ছাত্রজীবনেই রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। টাঙ্গাইল শহরের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে থাকতেই জাতীয় রাজনীতির বড় বড় ঘটনা আমাদের আলোড়িত করত। ছাত্রদের নানা দাবি নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের দাবি আদায় করা ইত্যাদি আমাকে রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করে তোলে। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে আমি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে নাম লেখাই। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৮৮ সালে আমি গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করি। ৯০’র গণ-আন্দোলন আমাদের ভিতরে এক অভ্যুত্থানের চেতনা জাগিয়ে তোলে। সরকারি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজে(এমএম আলী কলেজ) ভর্তি হবার পরে ১৯৯০ সালে আমি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি নির্বাচিত হই। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মিছিল থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং করাবরণ করি। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। আমি ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে সরকারি এমএম আলী কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ভিপি পদে বিপুল ভোটে জয়ী হই। ছাত্রদের স্বার্থে অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। পরপর দুইবার ভিপি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কলেজ শিক্ষার্থীদের ‘ভরসার মানুষ’ হতে পেরেছি।

যাযাদি: ছাত্ররাজনীতি থেকে আপনি কিভাবে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে এলেন?
ফরহাদ ইকবাল: মানুষের কষ্ট, বঞ্চনা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার রক্ত ঝরাতে হয়েছে। কিন্তু কখনও পিছপা হইনি। রাজনীতি আমার কাছে জনসেবা, ত্যাগ আর সততার মাধ্যম। আমি কখনো পদ-পদবি চাইনি। শুধু মানুষের পাশে থাকতে চেয়েছি। ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে ২০০২ সালে সভাপতি নির্বাচিত হই। ওই বছরই আমার সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিভাগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন কাজ করার পর ২০০৯ সালে আমাকে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। পরে ২০২১ সালে জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক মনোনীত হই। ছাত্রদল থেকে মূল দল- যখন যে দায়িত্ব পেয়েছি, তা নিষ্ঠা আর সততার সাথে পালন করেছি। দল আমাকে মূল্যায়ন করেছে বলেই ২০২১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছি। জেলা বিএনপির দায়িত্ব নেওয়ার পর দলীয় কার্যক্রমের গতি বাড়ে। নতুন করে কমিটি গঠন, তৃণমূলে কর্মী পুনর্বিন্যাস, জেলাব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি এবং ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ও সক্রিয় অংশগ্রহণ- সবকিছুই আমার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে।

যাযাদি: রাজনীতির পথ কখনো মসৃণ হয়না- নির্যাতন ও মামলা সম্পর্কে কিছু বলুন।
ফরহাদ ইকবাল: ২০০০ সালে হাসিনা বিরোধী আন্দোলন থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০৭ সালে ১/১১ এর সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ মিছিল শেষে প্রয়াত বর্ষিয়ান নেতা হান্নান শাহ্ এর বাসা থেকে জরুরি আইনে গ্রেপ্তার হই। ওই সময় আমাকে ক্রসফায়ারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় এবং মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে হায়েনারা ক্রস ফায়ার না দিয়ে ফেরত নিয়ে আসে। ওই মামলায় অমানষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘ ১৬ মাস কারাবরণ করি। এরপর আওয়ামী লীগের শাসনামলে আমি বারবার হামলা-মামলার শিকার হই। ২০১১ সালে হাসিনা বিরোধী আন্দোলন করায় গ্রেপ্তারের পর কারাবরণ করতে হয়। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের প্রতিবাদে আন্দোলন-সংগ্রাম করার অপরাধে নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকানো হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের একমাস আগে বিনা কারণে গ্রেপ্তার করে জেল-হাজতে রাখা হয়। ২০২৪ সালের অবৈধ নির্বাচনের প্রতিবাদে আন্দোলন করায় নির্বাচনের এক মাস আগে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকার গত ১৭ বছরে আমার নামে ২১টি মিথ্যা মামলা দায়ের করে এবং ১১ বার গ্রেপ্তার করে কারাবরণ করায়। একবার আমাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়- যেখানে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী ছিল। সেখানেও আমরা রাজনৈতিক আলোচনার টেবিল বসিয়ে দলীয় মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়। থানার লকআপ, আদালতের হাজত, এমনকি নির্জন সেলে রাত কাটিয়েছি- সবই দলের স্বার্থে সহ্য করেছি।

যাযাদি: টাঙ্গাইল-৫(সদর) আসনের ১২টি ইউনিয়নের চরাঞ্চলের মানুষের কাছে আপনার জনপ্রিয়তা অন্য যেকোন নেতার কাছে ঈর্ষণীয়- এর কারণ কি?
ফরহাদ ইকবাল: টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরাঞ্চল- যেখানে নৌকাই একমাত্র ভরসা, বিদ্যুৎ ও রাস্তাঘাটের অভাব, স্বাস্থ্যসেবা বলতে মাঝে মাঝে কোন এনজিওর মেডিকেল ক্যাম্প। চরাঞ্চলের মানুষের এ করুণ অবস্থা আমার সহ্য হয়নি। তাই একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়- সাধারণ মানুষ হিসেবে সকলের পাশে দাঁড়ানো চেষ্টা করেছি। বন্যা হলে আমি সবার আগে নৌকায় ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাই। নিজের ব্যক্তিগত তহবিল এবং বন্ধুদের সাহায্যে চাল, ডাল, ওষুধ, শিশুখাদ্য সরবরাহ করি। নির্বাচনের সময় নয় বরং দুর্যোগে-আপদে মানুষের পাশে থেকে আমি তাদের মন জয় করেছি। অনেক পরিবার আছে, যারা আমাকে তাদের সন্তানের বিয়ের দাওয়াত দেয়, এমনকি মৃত স্বজনের দাফনেও ডাকে।
যাযাদি: রাজনীতির ভবিষ্যৎ ও তরুণদের ভূমিকা সম্পর্কে বলুন।
ফরহাদ ইকবাল: বর্তমানে দেশের রাজনীতি সঙ্কটাপন্ন। একদলীয় শাসনের চেষ্টায় দেশবাসী অধিকার হারিয়েছে। কিন্তু তরুণরা জেগে উঠছে। তারা ভোটের অধিকার চায়, স্বাধীনতা চায়। আমি বিশ্বাস করি, সামনে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হবে- যেখানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে। তরুণরা রাজনীতিকে ভয় না পেয়ে এগিয়ে আসুক। সৎ মানুষ রাজনীতিতে না এলে দখল নেবে দুর্নীতিবাজরা। দেশ গড়তে হলে তরুণদের রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে। ২৪’-এর গণঅভ্যুত্থান তরুণদের জন্য প্রেরণা। তরুণদের জন্য আমার পরামর্শ হলো- ‘সৎভাবে রাজনীতিতে আসো। নিজের পকেটের লাভের জন্য নয়, মানুষের জন্য কাজ করো। ত্যাগ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। আজ আমি যা, তা ছাত্রদলের পোস্টার লাগানো, লাঠিপেটা খাওয়া, রক্ত দেওয়া পথ পেরিয়ে এসেছি।’
যাযাদি: দলীয় অবস্থা, লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
ফরহাদ ইকবাল: বিএনপি সারা দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই আগামিতে নির্বাচিত হবে ইনশাল্লাহ। বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলা বিএনপিকে সুসংগঠিত করতে নিরলসভাবে কাজ করছি। আমাদের প্রথম লক্ষ্য সংগঠনকে শক্তিশালী করা। টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলায় বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি গঠনে আমরা তরুণদের সুযোগ দিচ্ছি, অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিচ্ছি। দীর্ঘ তিন যুগ ধরে আমি টাঙ্গাইল-৫(সদর) আসনে দলীয় মনোয়ন প্রত্যাশি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোপূর্বে দলীয় হাই কমান্ডের সিদ্ধান্তে নির্বাচনে অংশ নেইনি। আগামি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমি টাঙ্গাইল-৫(সদর) আসনে দলীয় মনোনয়ন চাই। আশাকরি দল আমার ত্যাগ, কর্মনিষ্ঠা এবং জনপ্রিয়তা বিবেচনা করবে। তবে দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলেও তিনি জানান।
যাযাদি: দলীয় মনোনয়ন পেলে ত্রয়োদশ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আগে ও পরে আপনার ভূমিকা কি হবে?
ফরহাদ ইকবাল: আমি কোনোদিন ক্ষমতা, টাকা কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের জন্য রাজনীতি করিনি। আমি রাজনীতি করি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। আজ চরাঞ্চলের একজন কৃষকের ছেলে, শহরের রিকশাওয়ালা আমার ফোন নম্বর জানে, প্রয়োজনে ফোন দেয়, কারণ সে জানে তাদের ‘ফরহাদ ভাই’ প্রতিক্রিয়া দেন। ত্রয়োদশ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলে নির্বাচনী প্রচারণায় প্রথমেই আমি দেশের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের বা এমপির(সংসদ সদস্য) কাছে মানুষের কি কি পাওয়ার অধিকার রাখেন সে বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করব। নির্বাচিত হতে পারলে গণমানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করব। দলীয় মনোনয়ন পেলে টাঙ্গাইল-৫(সদর) আসনে আমি নিকটতম অন্য যেকোনো দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ৭০ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হবো বলে আশারাখি।
শেষ কথা:
টাঙ্গাইল শহরের বেপারীপাড়ায় জন্ম নেওয়া ফরহাদ ইকবাল পেশায় একজন অ্যাডভোকেট। তিনি টাঙ্গাইলের রাজনীতির সেই বিরল মুখ, যিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করেন মানুষের সেবায়। চরাঞ্চলের খরস্রোতা নদীর মতোই তার সংগ্রামমুখর জীবন, যেখানে বাধা এসেছে বারবার- কিন্তু থামিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি গড়ে উঠেছেন মাঠের রাজনীতি থেকে, নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে। টাঙ্গাইলের সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষ, তাকে শুধু রাজনীতিক বা সমাজসেবী নন- একজন আপনজন, অভিভাবক, আশ্রয় মনে করেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ ধারণ করে একজন প্রকৃত তৃণমূল নেতা হিসেবে তিনি আজও রাজপথে, জনগণের পাশে থেকে সততা দিয়ে জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার মতো নিবেদিতপ্রাণ নেতারাই হয়তো একদিন দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে পারবেন- এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের।