টাঙ্গাইলের সখীপুরে অপকারী বৃক্ষ ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছে সয়লাব সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সড়কের দুইপাশ, পুকুর পাড়, ফসলি জমির আইল থেকে শুরু করে সর্বত্র রয়েছে এ গাছটি।
ইতোমধ্যে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের চারা রোপণ উত্তোলন বিক্রি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
আগ্রাসী প্রজাতির ইউক্যালিপটাস গাছ নিষিদ্ধ করা হলেও সচেতনতার অভাবে মানছেন না কেউ, নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র।
প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ গাছ মানুষের বন্ধু ও পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপকরণ। সুন্দর পৃথিবীকে পরিবেশ বান্ধব বাসযোগ্য রাখতে গাছের কোন বিকল্প নেই। তাই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ভারসাম্য রক্ষার্থে উপকরণ রাষ্ট্রের মোট ভূ-ভাগের অন্তত পঁচিশ ভাগ বনভূমির একান্ত আবশ্যকতা বিশ্বজুড়ে জোরালো কণ্ঠে বলে আসছেন।

কিন্তু সকল গাছ মানুষের জন্য শুধুই উপকারী কিংবা পরিবেশ বান্ধব নয়। যে-সব গাছ মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই করে বেশি তেমনই একটি গাছের নাম ইউক্যালিপটাস ।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিদিন একটি ইউক্যালিপটাস গাছ ৪০ থেকে ৪৫ লিটার পানি ইউক্যালিপটাস করে । এছাড়া মাটির নিচে গোড়ায় ২০ থেকে ৩০ ফিট জায়গা নিয়ে চারিদিকে থেকে গাছটি পানি শোষণ করে বলে অন্যান্য ফসল ও ফলদ গাছের ফলন ভাল হয় না ।
তাছাড়া মুক্ত আকাশে ডানা মেলা পাখিদের ডালে ডালে অবাধ বিতরণেও এই গাছ খুব সহায়ক নয় ।
গাছটি কেটে ফেললেও মাটির উর্বরতা ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। এমনকি এ গাছের ফুল ও ফল ঝরে পড়লে সেখানে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয়। এই গাছের ফুল এবং পাপড়িগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের শ্বাসনালিতে ঢুকে শ্বাসকষ্ট এবং হার্টের অসুখ সৃষ্টি করে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের জলবায়ুর জন্য অত্যন্ত বিপদজ্জনক গাছ হলো ইউক্যালিপটাস।
ইউক্যালিপটাসের পাতায় এক ধরনের অ্যান্টিসেপটিক থাকায় এর নিচে ছোট গাছ বাড়তে পারে না। মারা যায় পোকা মাকড়ও। যেখানে একসঙ্গে সব ধরনের ছোট বড় গাছ ফসল এবং জলাশয় আছে সেই পরিবেশে এই গাছটি ব্যাপক ক্ষতিকারক।
পরিবেশ উপযোগী নয় বিধায় ১৫ মে ২০২৫ সালে সরকারের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে দেশে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনির চারা উৎপাদন ও রোপণ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু বাস্তবে উপজেলা জুড়েই চলছে ইউক্যালিপটাস রোপণের হিড়িক।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, ইউক্যালিপটাসের শত শত বাগান। উপজেলার দশটি ইউনিয়নেই ব্যাপকভাবে ইউক্যালিপটাস চারা উৎপাদন ও রোপণ করা হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ । হাট-বাজারে গুলোতে গিয়ে দেখা যায় নিষিদ্ধ গাছের চারা দেদারসে বিক্রি করা হচ্ছে।
উপজেলার কীর্তনখোলা চৌরাস্তা বাজারর ইউক্যালিপটাস গাছের ক্রেতা আল আমিন ও আবুল হোসেন জানান, পরিত্যক্ত জমিতে রোপণের জন্য কিছু চারা কিনেছি। এ গাছ যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও বেচা-কেনা নিষিদ্ধ তা আমাদের জানা ছিলনা।
নিষিদ্ধ গাছের চারা উৎপাদনে সরকারি নিয়ম নীতির কোনো তোয়াক্কাই করছেন না স্থানীয় নার্সারি মালিকরা । কারণ অন্যান্য বনজ বা ফলদ চারার চেয়ে এই চারা উৎপাদনে ২ থেকে ৩ গুন বেশি লাভ হয় । এজন্য তারা বেশি বেশি চারা উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করছেন।
ফলে বিস্তীর্ণ এলাকায় স্কুলকলেজ, বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট, খেলার মাঠ, হাট-বাজার এমনকি উর্বর ফসলের মাঠজুড়ে সবজি, ধান, গম, আলু, সরিষার সাথে সাথে ব্যাপক হারে শোভা পাচ্ছে অপকারী বৃক্ষ ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি।
এ বিষয়ে উপজেলর শোলা প্রতিমা গ্রামের নার্সারি ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, সরকারি প্রজ্ঞাপনের ব্যাপারে কিছু জানি না। বনবিভাগ থেকে আমাদেরকে কিছু জানানো হয়নি। কোনো গাছের বিষয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলে আমরা তা উৎপাদন ও বিক্রি করবো না।
উৎপাদন বন্ধে কিংবা জনগণকে রোপনে নিরুৎসাহিত করতে স্থানীয় বন বিভাগ কর্মকর্তাগণ কতটুকু আন্তরিক কিংবা কতটুকু তৎপর বা আদৌ তাদের কোন নজরদারি আছে কিনা সেই প্রশ্নটি যে কোন সচেতন মনে জাগতেই পারে। সবকিছু মিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় সচেতন মহলসহ পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা ।
হতেয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রশিদ বলেন, ইউক্যালিপটাস এবং আকাশমনি গাছের চারা উৎপাদন,উত্তোলন, রোপণ ও বিক্রি নিষিদ্ধে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এসব গাছের চারা রোপণ, ক্রয়-বিক্রয়ে নিরুৎসাহিত করতে নার্সারি মালিক ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে কথা বলেছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নিয়ন্তা বর্মন বলেন, এ বছর উপজেলায় প্রায় ২০ লাখ নিষিদ্ধ ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির চারা উৎপাদন করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই আমরা নার্সারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে চারা উৎপাদন ও বিক্রি করতে নিষেধ করেছি। উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এ সপ্তাহের মধ্যেই অপকারি চারা ধ্বংস করতে কার্যক্রম চালানো হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজের ‘উদ্ভিদ বিজ্ঞান’ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান খায়রুন নাহার মল্লিক শিফা জানান, ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছ দুটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় পৃথিবীর অনেক দেশেই তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সহজলভ্য ও দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় আমাদের দেশে তা ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বাংলাদেশ সরকারের এ পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, আমাদের দেশে বাস্তুসংস্থান ঠিক রাখতে গেলে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছের চারা রোপণ একেবারেই বন্ধ করার ব্যাপারে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।