বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিদ্যমান সমস্যা-সংকট কাটিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছেন প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সোমবার বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে প্রথম দিনের আলোচনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা, দেশের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিতসহ যৌক্তিক সময়ে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিজ নিজ দলের মতামত তুলে ধরেছেন। তবে অধিকাংশ দলই নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজন অনুযায়ী সময় দিতে চায়।
জানা গেছে, প্রথম দিনের বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কি কি করা যায়, সে বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও দলগুলোর নেতাদের অবহিত করেছেনÑ আগামীতে তারা কি কি করতে যাচ্ছেন, আশু করণীয় কি কিÑ সেসব বিষয়ে। সংকট কাটিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে সহযোগিতাও চেয়েছেন নতুন অন্তর্বর্তী সরকার।
সূত্র জানায়, বৈঠকে দলগুলোর নেতারা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করা রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের একমাত্র কর্তব্য। একটি নির্দিষ্ট সময় লাগবেই তাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে। তারা সে সময় দিয়েছেন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশ পরিচালনায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারকে। কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থারও সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন।
প্রথম দিনে বিএনপি ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করেন জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণতন্ত্র মঞ্চ, সিপিবি, বাসদ, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের সঙ্গে। তবে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হবে কিনা-তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়নি। বিএনপি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার প্রথম দিন সোমবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি বাসভবন যমুনায় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির প্রতিনিধি দলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাউদ্দিন আহমেদ, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান প্রমুখ।
বৈঠক শেষে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে আলোচনা হয়নি বলে দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। যমুনার বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সামনে তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলিনি। একটি নির্দিষ্ট সময় লাগবেই তাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে। আমরা সে সময় দিয়েছি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছি। মূলত, গণতন্ত্র হত্যাকারী, গণবিরোধী যে ফ্যাসিস্ট সরকার, যারা দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ধরে এই দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে একটি ফ্যাসিস্ট রুল কায়েম করেছিল।
ছাত্র, জনগণের আন্দোলনে, রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের ফলে আজকে একটি মুক্ত পরিবেশে এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এই প্রথম তারা আজকে আমাদের সঙ্গে বসেছেন।
তিনি বলেন, আমরা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কি কি করা যায়, সে বিষয়ে মতামত দিয়েছি। তারা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন কী করতে যাচ্ছেন। এখন মনে করি, সরকারকে সহায়তা করা প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের একমাত্র কর্তব্য। বৈঠকের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছি, তথাকথিত (সংখ্যালঘু) ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের যে গল্প ফাঁদা হয়েছে, সে গল্পটা পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক।
বাংলাদেশকে ম্যালাইন করা, এই সরকারকে ম্যালাইন করা, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়ার আরেকটি চক্রান্ত। খুবই দুর্ভাগ্যজনক, এত হত্যা, এত নির্যাতন, এত শিশুকে হত্যা করার পরও সেই দলটি আবারও বিভিন্ন রকম কথা বলছে, যা বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে। আমরা মনে করি, সরকারের এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি সরকার অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। তবে অবশ্যই কোনো হত্যাকারীর সঙ্গে নয়। যারা ছাত্রকে হত্যা করেছে, যারা শিশুকে হত্যা করেছে, যারা রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে জনগণ আছে এবং এই ব্যাপারে সরকার ব্যবস্থা নিতে গেলে অবশ্যই সহযোগিতা করা হবে। দেশের ভালো-মন্দের বিষয়ে আলোচনা করেছি- জামায়াতের আমির ॥ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে আসা দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যমুনায় বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠক শেষে বেরিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডাঃ শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। উনারা কেবল বসলেন, মাত্র চারটা দিন হলো, আমরা দেখতে চাই উনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) কীভাবে জাতিকে নিয়ে এগোতে চাচ্ছেন। সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে করেন। যৌক্তিক সময়ে সমাধান হবে বলে আমরা আশাবাদী।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন জাতির জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট চলছে। আমরা প্রধান উপদেষ্টার দাওয়াতে এখানে এসেছিলাম। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এখন করণীয় কী, সেই বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। দেশ আমাদের সবার। দেশ ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকব। আমরা যদি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করি, সবাইকে সহযোগী করি, এখন যারা দায়িত্বে এসেছেন তাদেরকে সহযোগিতা করি; তাহলে দেশ একটা শৃঙ্খলা ও সুন্দরের মধ্যে আসবে বলে আমরা মনে করি।
অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে জাতিকে এগিয়ে নেবে, আমরা দেখতে চাই উল্লেখ করে জামায়াতের আমির আরও বলেন, আন্দোলনে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন তাদের জন্য দোয়া করেছি। যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সুস্থতা কামনা করেছি। দেশের বিভিন্ন ভালো-মন্দ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি।
ডাঃ শফিকুর রহমান বলেন, আমাদের এখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ যারা আছেন তাদের ওপর বিভিন্ন জায়গায় কিছু হামলা হয়েছে। হামলা ধর্মীয় কারণে হয়েছে নাকি রাজনৈতিক কারণ আছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। বিভিন্ন ধর্মের নেতারাই বলেছেন, যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোকে ধর্মীয় হামলা বলে চালানো যাবে না। একজন রাজনীতি করত, রাজনীতি করতে গিয়ে মানুষের ওপর অনেক অপরাধ করেছে, সেই ক্ষোভ থেকে হয়ত তার ওপর হামলা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা এখানে দলীয় দাবি নিয়ে আসিনি। জাতীয় স্বার্থের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। দলীয় বিষয় আছে, এগুলো থাকবে। কথা হচ্ছে যে, কেউ আমাদের নিষিদ্ধ করে দিল, আমরা নিষিদ্ধ হয়ে গেলামÑ সেটা আমরা মনে করি না। শেষেরদিকে সরকার অনেক ভুল কাজ করেছে। সেটার মাসুল হয়ত দেশবাসীকে দিতে হবে, সরকারকে তো দিতেই হবে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। সেদিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ ১৩ উপদেষ্টা শপথ নেন।
এর পর গত রবিবার আরও দুই উপদেষ্টা শপথ নেন। ১৬ উপদেষ্টার মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম যুক্তরাষ্ট্রে থাকার কারণে শপথ নিতে পারেননি। তিনি রবিবার রাতে দেশে ফিরেছেন এবং আজ মঙ্গলবার তার শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে।