সুন্দরবন ঘুরে বাড়িতে গিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ। ভোটের পরে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে আগেভাগে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। পাশাপাশি নতুন টিউশনি পেয়েছেন। আবার চলতি মাসের শেষের দিকে একটি চাকরির পরীক্ষাও আছে। তাই আবারও বাড়ি ফিরতে হবে। সবকিছু মাথায় রেখেই আজ শুক্রবার তিনি চুয়াডাঙ্গা থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেসে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।
ট্রেনে ওঠার পর থেকে রাজু ঘুমাননি। কারণ, যদি কোথাও লাইন কাটা থাকে বা দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে যেন দ্রুত নেমে পড়তে পারেন, সেই আশঙ্কায় সারাক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেছেন। তবে রাজু ও তাঁর পরিবারের শঙ্কা সত্যি হয়েছে। কমলাপুর পৌঁছানোর ঠিক আগেই রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে আগুন লেগে যায়। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে ক্যাম্পাসে ফিরেছেন। সেখানেই প্রতিবেদককে তিনি ঘটনার বর্ণনা দেন।
ঢাকায় ট্রেনে আগুনে নিহতদের মধ্যে দুই শিশু।
কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছানোর অল্প কিছুক্ষণ আগে রাত ৯টার দিকে ট্রেনটিতে আগুন লাগে। অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের এক বার্তায় বলা হয়, দুর্বৃত্তরা বেনাপোল এক্সপ্রেসের তিনটি কোচ ও একটি পাওয়ার কারে আগুন দিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
বেনাপোল এক্সপ্রেসের যাত্রী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ
বেনাপোল এক্সপ্রেসের যাত্রী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদছবি: সংগৃহীত
রাজু বলেন, তিনি ছিলেন ‘জ’ কোচে। সেই কোচের শৌচাগারের লক নষ্ট থাকায় সামনের বগি ‘ছ’তে যান। সেখানে শৌচাগার থেকে বেরিয়ে তিনি সামনের ‘চ’ এসি কোচে আগুন দেখতে পান। পরে দ্রুত লাফিয়ে নেমে পড়েন ট্রেন থেকে। তাঁর বগিতে প্রায় শতাধিক সিটের পাশাপাশি অতিরিক্ত ২০-৩০ জন দাঁড়ানো যাত্রী ছিলেন।
রাজু আহমেদ বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গা থেকে বিকেল চারটায় ট্রেনে উঠি। কমলাপুর রেলস্টেশনে রাত নয়টায় নামার কথা ছিল। ঢাকার কাছাকাছি আসার সময় ভেবেছিলাম বাসার পাশে গেন্ডারিয়া স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালে নেমে যাব। পরে ট্রেন না দাঁড়ানোয় ব্যাগ সঙ্গে নিয়েই টয়লেটে যাই। গিয়ে দেখি আমাদের বগির টয়লেট গেটের লক নষ্ট। পরে সামনের বগির টয়লেটে যাই। সেই বগিতে এলাকার এক ছোট ভাই ছিল, দুজনের একসঙ্গে নামারও কথা ছিল।’
কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছানোর অল্প কিছুক্ষণ আগে রাত ৯টার দিকে ট্রেনটিতে আগুন লাগে।
আগুন কয়েকটি বগিতে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ট্রেনের জানালা দিয়ে হয়তো বের হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জানালায় (গোল চিহ্নিত) এসেই নিভে যায় জীবন প্রদীপ।
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।
আগুন দেখার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাবাসী যে যার মতো করে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।
একটি বগি থেকে ব্যাগে করে লাশ বের করে আনছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ট্রেনের পুড়ে যাওয়া একটি বগির ভেতরের দৃশ্য। এখানে যে কিছুক্ষণ আগেও প্রাণের ছোঁয়া ছিল, তা বোঝার উপায় নেই।
আগুন নেভানোর পর বগিগুলো পরিদর্শন করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ট্রেনের যাত্রীদের আহাজারি।
কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছানোর অল্প কিছুক্ষণ আগে রাত ৯টার দিকে ট্রেনটিতে আগুন লাগে।
রাজু আহমেদ আরও বলেন, ‘টয়লেটে গিয়ে বাইরে থেকে মানুষের চিৎকার শুনতে পাই। ভেবেছিলাম হয়তো ট্রেন স্লো করেছে। মানুষ নামছে। দ্রুত টয়লেট থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে শুনি ট্রেনে আগুন লেগেছে। টয়লেট থেকে বের হতে পারছিলাম না মানুষের ভিড়ে। সামনে এক নারী তাঁর তিনটি বড় ব্যাগ নিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিলেন। তাঁকে ঠেলে নেমে পড়ি। পরে উনিও নেমে পড়লে সবাই নামার চেষ্টা করে।’
ট্রেনটি আগুন লাগার পর যে স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল, সে স্থানে ট্রেন থেকে নামা অনেক কষ্টের ছিল বলে জানান রাজু আহমেদ। বলেন, কারণ এখানে তো প্ল্যাটফর্ম ছিল না। তাই সবার নামতে কষ্ট হচ্ছিল।
‘৩০ সেকেন্ডের কম সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে’ উল্লেখ করে রাজু বলেন, ‘নেমে চোখের সামনেই দেখি চ বগিতে আগুন লেগেছে। ৩০ সেকেন্ডের কম সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দূর থেকে মনে হচ্ছিল অনেক মানুষ ভেতরে আটকা পড়েছিল। ঘটনার আশপাশে ট্রেনের বগি থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ছিল। আর এসি বগিগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হচ্ছিল। তখন আশপাশ কেঁপে উঠছিল। ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি।’