ড. মোহাম্মদ একরামুল ইসলামঃ ‘লুকাস’ গল্পটি শাহেদ আলীর ‘অমর কাহিনি’ গল্পগ্রন্থে’র অন্তর্ভুক্ত।‘অমর কাহিনি’-তে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলো ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে রচিত হয়েছে বলে গল্পকার গ্রন্থের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন। গ্রন্থটি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়। তবে ‘লুকাস’ গল্পটি ১৯৭২ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে রচিত। কথাশিল্পী শাহেদ আলীর ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য এই যে, তার প্রত্যেকটি লেখাই হৃদয়ের স্পর্শে আন্তরিক, তাতে কোনো ছলনা নেই। জীবনকে ভিত্তি করেই তিনি কাহিনি নির্মাণ করেন। জীবনের কতো দিক রয়েছে- সামাজিক, মনস্তাত্বিক, আধ্যাত্মিক। বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে একেকটি রূপ লেখকের চিত্তে উদ্ভাসিত হয়। যিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেই রূপটিকে তার রচনায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন, তিনিই সাার্থক শিল্পী। শাহেদ আলী এই ধরনের একজন শিল্পী। জীবনবাদী এই লেখক জীবনকে দেখেছেন নানাভাবে, নানা দৃষ্টিকোন থেকে। অতি ক্ষুদ্র বিষয়, তুচ্ছ ঘটনার মধ্যেও অন্তর্নিহিত থাকে বৃহৎ তাৎপর্য। এ তাৎপর্য সকলের কাছে ধরা পড়ে না। কেবল তারই কাছে ধরা পড়ে, যার সেই দৃষ্টি আছে। যার আছে মানুষের ও সৃষ্টির প্রতি গভীর প্রেম। এ জেড এম শামসুল আলম শাহেদ আলীকে একজন জীবনবাদী লেখক হিসেবে উল্লেখ করেন। ‘লুকাস’ গল্পটি গল্পকারের জীবনের খাতা থেকে গৃহীত বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ এই কাহিনির কেন্দ্রিয় চরিত্রগুলি কল্পিত নয় বরং বাস্তব। স্বনামেই চরিত্রগুলি কাহিনিতে স্থান পেয়েছে। বাস্তবে যা ঘটেছে তাই-ই কাহিনি আকারে লিখিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গল্পলেখক তার অধিকাংশ গল্পের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই।
‘লুকাস’ গল্পটিতে চিকিৎসা পেশায় জড়িত কিছু চরিত্রের চিত্রাংকন করেছেন অধ্যাপক শাহেদ আলী। আমরা জানি যে, চিকিৎসা সেবায় ডাক্তারদের কিংবা নার্সদের সততা, নিষ্ঠা ও সহমর্মিতার সাথে জাত-পাত, ধর্ম—বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে আপন ভেবেই যত্ন করতে হয়। স্বাস্থ্য-কর্মীদের একটি বড় গুণ থাকা চাই— মানবিকতা। রোগীর কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করে সেবার মান বাড়ানোই একজন স্বাস্থ্য-কর্মীর মানবতার মূলভিত্তি। চিকিৎসা পেশা একটি মহৎ পেশা তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। গল্পকারের সাথে এই রকম একজন মানবিকতাগুণে গুণান্বিত নার্স, যার নাম লুকাস-এর সাথে একটি হাসপাতালে পরিচিত হন এবং তার ইতিবাচক ব্যবহারে মুগ্ধ হন। গল্পকার লুকাসকে যেমন দেখেছেন তেমনি দেখেছেন নেতিবাচক চরিত্রের উপস্থিতি।
গল্পকার লুকাসের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবার সাথে ইতিবাচক দিক যেমন দেখিয়েছেন ঠিক তেমনি দেখিয়েছেন ড. আনসারীর মাধ্যমে নেতিবাচক দিক। গল্পকার অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। ঐ সময় গ্রীক এর নাগরিক লুকাসের সাথে তার পরিচয়। লুকাস হাসপাতালের নার্স। লুকাসের মা ভারতীয় আর বাবা গ্রীক। এই নার্সের নামানুসারেই গল্পের নাম রাখা হয়েছে লুকাস। মূলত গল্পকারের সাথে ভালোলাগা একটি সর্ম্পক সৃষ্টি হয় লুকাসের। এটাকে ভালোবাসা বলা যায় না, হয়তো ভালোবাসা সৃষ্টির প্রারম্ভিক পর্যায় বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত লেখিকা ও কবি মায়া অ্যাঞ্জেলিও (১৯৮২-২০১৪) তার এক লেখায় উল্লেখ করেন- “একজন নার্স হিসেবে আমাদের সুযোগ আছে আমাদের রোগীদের মন, আত্মা, হৃদয় ও শরীরকে সুস্থ করে তোলার। তারা হয়তো আপনার নাম ভুলে যাবে, কিন্তু কখনোই ভুলবে না আপনি তাদের কেমন অনুভূতি দিয়েছিলেন।”
একজন নার্স যখন ভালোবাসা, সহানুভূতি, স্নেহ ও যত্ন দিয়ে রোগীর পাশে দাঁড়ান, তখন সেই রোগী আশার আলো খুঁজে পান। হয়তো সময়ের সাথে রোগী নার্সের নাম ভুলে যাবেন, কিন্তু যে মানবিকতা ও অনুভূতি তিনি পেয়েছেন, তা কখনো ভুলবেন না। আসলে, রোগীর প্রতি যত্নশীল আচরণ ও সহানুভূতি চিকিৎসার মতোই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেটাই রোগীর মনে স্থায়ী ছাপ রেখে যায় এবং তাকে মানসিক শক্তি জোগায়। লুকাস যেন মায়া অ্যাঞ্জলিও-এর কথাকে বাস্তবায়ন করেন। এর সত্যতার প্রমাণ গল্প থেকেই পাওয়া যায়। যেমন— “নার্সটি (লুকাস) পালস নিতে নিতে বলে, কিডনি অপারেশন মেজর অপারেশন। এই বয়সে কিডনি অপারেশন আমিতো ঘাবরেই গেছিলাম। যাক বাঁচা গেল। লক্ষ্য করলাম সহানুভূতি আর সমবেদনায় জ্বলজ্বল করছে ওর চোখ দুটো। লুকাস তার কর্মে খুবই আন্তরিক। রোগীদের প্রতি রয়েছে মমতা ও সহানুভূতি। কর্মে কর্মঠ ও তৎপর।
এই রকম একজন নার্সকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেন তরুণ ডাক্তার আনসারী। এই সব কুলাঙ্গার উচ্চশিক্ষিত লোক চিকিৎসা সেবার বদনাম করছেন। গল্পে যেমন আনসারী ঠিক সেই রকম ঘটনা এখনও ঘটাচ্ছে আনসারী টাইপ ডাক্তারগুলো। মওলানা ভাসানী তার শিক্ষাদর্শনে উল্লেখ করেন আধুনিক শিক্ষার জ্ঞানার্জন করলেও তাকে উচ্চ শিক্ষিত বলা যাবে না। চাই নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষার অভাব হলেই হতে পারে চরিত্রের স্খলন। ডা. আনসারীর ক্ষেত্রে ঘটেছেও তাই। তাইতো সুন্দরী নার্সকে দেখে পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়েন নাইট ডিউটি কর্মরত নার্স লুকাসের উপর। লুকাসের সৌন্দর্যের বর্ণনায় গল্পকার লিখেন- “উঁচু নয়, খাটোও নয়, হালকা পাতলা গড়ন মাথার সামনের দিকে চুল ফুলিয়ে রাখে তাতে সে যতটুকু উঁচু তার চাইতে তাকে আরো উঁচু মনে হয়। মুখখানা ভারী সুন্দর যেন একটা গোলাপ ফুল ফুটে আছে। বড় বড় দুটি চোখ, একটা দ্যুতি যেন ঠিকরে পড়ছে চোখ দুটি থেকে। কমপ্যাক্ট শরীর বয়স কুড়ির বেশি নয়, স্কাট পরেও বলে তার পাগুলো দেখা যায় একটু যাকে বলে বো- লেগেড হাঁটুর নীচে খুব সামন্য একটু বাঁকা।”
কর্মরত সহকর্মীদের সুদৃষ্টিতে দেখতে না পারা ডা. আনসারীর একটি চরম ব্যর্থতা এবং তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যার ফলে সম্মানের জায়গাটি হারান ডা. আনসারী। আমেরিকায় স্বাস্থ্যবীমা এক্সর্পাট ওয়েস ফিশারের ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে একটি বিখ্যাত উক্তি হলো— “একজন ডাক্তার হিসেবে মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করবে, আপনার কাছে মনের কথা বলবে এবং আপনার প্রচেষ্টাকে মূল্যায়ন করবে। যদি আপনি আপনার সিস্টেমকে ভেঙে দিতে না দেন, তবে আপনি মানুষের জন্য অসাধারণ কাজ করতে পারবেন”।
একজন ডাক্তার হিসেবে আপনি শুধু চিকিৎসক নন, মানুষের আস্থার প্রতীক। মানুষ আপনার উপর ভরসা করবে, তাদের কষ্টের কথা আপনাকে জানাবে এবং আপনার নিঃস্বার্থ পরিশ্রমকে কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করবে। সিস্টেমের বাঁধা আপনাকে কখনো থামাতে পারবে না, যদি আপনি দৃঢ় থাকেন। তখন আপনি মানুষের জীবনে সত্যিকারের আলো ছড়াতে পারবেন। ওয়েস ফিশার [বিং ভরংপযবৎ] ঠিক বলেছেন।
বর্তমান যুগে ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এক সঙ্গে কাজ করছে যা দেশের সমৃদ্ধির একটি বড় কারণ। তাই ‘লুকাস’ গল্পের মাধ্যমে গল্পকার সবাইকে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব দেওয়ার আহবান করছে এবং অফিস আদালত ও কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও নিপীড়ন রোধকল্পে দোষী সাব্যস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে কঠিন আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কর্মপরিবেশ (ড়িৎশরহম ঊহারৎড়হসবহঃ) ব্যতীত জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই পুরুষ ও মহিলা কর্মকর্তা কর্মচারীর সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। ‘লুকাস’ গল্পের লুকাসের মতো যেন অপদস্থ নিপীড়িত হয়ে কর্মস্থল পরিবর্তনের বিষয়টি না ঘটে। ‘লুকাস’ গল্পের উপজীব্য বিষয় বর্তমান সময়ে যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ধর্মীয় অবক্ষয়ে আমাদের মন-মানসিকতায় যেন গুণে ধরছে। বিবেককে করছে ধ্বংস। তাই গল্পকার লুকাস চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক অবক্ষয়েরই প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন।
লেখক: ট্রেজারার, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়।