বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বলে আসছে, তারা ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পাঠানোর বিষয়টি ভাবছে। দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়া—এ রকম কোনো অভিযোগ বা বিতর্ক আর যাতে না ওঠে, সে জন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুর্গম এলাকা বাদে সারা দেশে ভোটের দিন সকালেই কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানোর বিষয়টি ভাবছে নির্বাচন কমিশন। তবে পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অনেকে মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের এমন ভাবনা বাস্তবসম্মত নয়। ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পৌঁছাতে গেলে নিরাপত্তার সমস্যা হতে পারে।
ভোটের আগের দিন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পৌঁছে দেওয়ার পক্ষে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা। জনবল–সংকটের কারণে ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করেন তাঁরা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্বাচনী প্রশিক্ষণে নিজেদের এমন মনোভাবের কথা তাঁরা তুলে ধরেছেন।
গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া দুদিনের এই প্রশিক্ষণ গতকাল রোববার শেষ হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার প্রশিক্ষণের একটি ক্লাসে ভোটকেন্দ্রে সকালে ব্যালট পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। তখন পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে কিছু কারণ দেখিয়ে ইসির চিন্তার সঙ্গে একমত হননি। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো ইসিকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পাঠাতে হলে আগের রাতে জেলা বা উপজেলায় পৌঁছাতে হবে। সেখানে যে সিল মারা হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তবে জেলা–উপজেলা সদরে নিরাপত্তা তুলনামূলক বেশি থাকে।
দুদিনের এই প্রশিক্ষণে বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের উপমহাপরিদর্শক, মহানগর পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মিলিয়ে ১১৭ জন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ভোটের আগের দিন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের মনোভাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন কয়েকজন জেলা প্রশাসকও।
সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের দিন বিকেলে বা সন্ধ্যায় ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ভোটের আগের দিন ব্যালট পেপার ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যান। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের (৩০ ডিসেম্বর) আগের রাতেই বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে রাখা হয় বলে অভিযোগ করে আসছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো।
গুরুতর এই অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলেন তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ‘ব্যর্থতার গ্লানি’ হিসেবে উল্লেখ করে এক সাক্ষাৎকারে (২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত) বলেছিলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারভর্তি বাক্সের ছবি বিবিসির সাংবাদিক প্রকাশ করেছেন। এই অভিযোগ খণ্ডনের কোনো উপায় ছিল না। কারণ, এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।’
রাতের ভোট নিয়ে নানা অভিযোগ ও বিতর্কের মুখে বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বলে আসছে, তারা ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পাঠানোর বিষয়টি চিন্তা করছে। শুধু দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, হাওর ও দ্বীপাঞ্চলে ভোটের আগের দিন ব্যালট পাঠানো হবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের দিন সকালেই ব্যালট পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া গত আগস্টে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে দুর্গম ও দ্বীপাঞ্চল ছাড়া অন্য এলাকায় ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানোর চিন্তা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত শনিবার প্রশিক্ষণের একটি ক্লাসে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। সরকারের তিনজন সচিব প্রশিক্ষক হিসেবে তখন ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাঁরা সকালে ব্যালট পেপার পাঠানোর কথা বলেন এবং এ বিষয়ে মতামত জানতে চান। তখন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যখন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হয়, তখন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে প্রধানত পুলিশ। ভোটের দিন সকালে সব ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠাতে হলে সমস্যা হবে।
কারণ, ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ভোটকেন্দ্র ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ভোটের আগের দিনই তাঁরা ভোটকেন্দ্রে চলে যান। তাই ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার পৌঁছাতে গেলে জনবল–সংকটের কারণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। আবার সকালে ভোটকেন্দ্র থেকে পুলিশ সদস্যরা নির্ধারিত কোনো কার্যালয় থেকে ব্যালট আনতে গেলে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
বৈঠকে কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন বা উপনির্বাচনে সকালে ব্যালট পেপার পাঠাতে সমস্যা হয় না। কারণ, এসব নির্বাচন হয় ছোট একটি এলাকায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও পর্যাপ্ত থাকেন। কিন্তু সারা দেশে যখন এক দিনে ভোট হবে, তখন জনবলের সংকট হবে। সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট নিতে হলে চাপ বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আলোচনায় পুলিশের কোনো কোনো কর্মকর্তা বলেন, ভোট হবে শীতের সময়। শীতকালে সকালে কুয়াশার কারণে অনেক জায়গায় রাস্তায় সমস্যা হতে পারে। আবার কেউ কেউ মত দেন, দুর্গম এলাকায় ভোটের আগের দিন এবং যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ও সদর থেকে কাছাকাছি এমন জায়গায় ভোটের সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই ক্লাসে কর্মকর্তাদের ভোটের সময় ইসিকে সব ধরনের সহযোগিতা করার নির্দেশনা দেন সচিবেরা। অতি উৎসাহী হয়ে কাউকে কিছু না করারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
ইসির প্রশিক্ষণে পুলিশ ও কোনো কোনো জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভোটের আগের দিন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হোক—এ বিষয়ে কমিশন কী ভাবছে, এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গতকাল রোববার নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
যেখানে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার পাঠানো সম্ভব, সেখানে সকালে আর যেখানে সম্ভব হবে না, সেখানে আগের দিন ব্যালট পেপার পাঠানোর বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
আগামী ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করার কথা বলে আসছে ইসি। সংসদের ৩০০ আসনে ভোটকেন্দ্র হবে ৪২ হাজারের কিছু বেশি। ইসি মনে করে দ্বীপ, হাওর ও পার্বত্য এলাকাগুলো বাদে অন্য সবখানে ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো সম্ভব। কারণ, এখন যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় সব এলাকায় ভালো।
ইসির প্রাথমিক পরিকল্পনায় ভোটের আগের দিন দেশের সব উপজেলা সদরে ব্যালট পেপার পাঠানোর বিষয়টি রয়েছে। সেখান থেকে ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ব্যালট পেপার পাঠানো হবে। এ জন্য প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার ভোটকেন্দ্রগুলোকে কয়েকটি রুটে (পথে) ভাগ করার কথা ভাবছে তারা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পাঠাতে হলে আগের রাতে জেলা বা উপজেলায় পৌঁছাতে হবে। সেখানে যে সিল মারা হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তবে জেলা–উপজেলা সদরে নিরাপত্তা তুলনামূলক বেশি থাকে। যদি ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রে আগের রাতে ব্যালট পাঠানো হয়, তাহলে রাতের ভোটের ঝুঁকিটা বেশি থাকবে। তাই এই দুটি বিকল্পের মধ্যে ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানোই ভালো হবে।