যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য সুশীল সমাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক, চিন্তক, শিল্পী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক, সমাজ গবেষক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও বিভিন্ন বেসরকারি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান মিলে গড়ে ওঠে একটা দেশের সুশীল সমাজ তথা নাগরিক সমাজ। যাদের কাজ হচ্ছে নাগরিকের স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, রাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করা, সর্বোপরি নাগরিকের একটা বলিষ্ঠ স্বর হিসেবে কাজ করা।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র জন্মলগ্ন থেকেই বারবার হোঁচট খেয়েছে, তবু এ দেশের মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা কখনো দুর্বল হয়নি। অপরিণত গণতন্ত্র হলেও আমাদের একটা ক্রিয়াশীল সুশীল সমাজ রয়েছে। যেকোনো বিবেচক নাগরিকেরই সুশীল হয়ে ওঠার স্বপ্ন থাকার কথা। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ‘সুশীল’ কথাটি এখন আমাদের দেশে একটা বহুল ব্যবহৃত গালিতে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সরাসরি আলাপচারিতায় কিংবা আড্ডায় কেউ কারো কোনো কথার প্রতিবাদ করার সময় কটাক্ষ করে বলে, ‘সুশীল’, ‘আসছে, সুশীল কোথাকার!’ ‘সুশীলগিরি বাদ দেন’ ইত্যাদি। এ গালির অর্থময়তা সমাজে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে যাকে গালিটি দেওয়া হয়, তিনি নিজের মতামতের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি অবশ্যই জোরগলায় এটিও প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন যে তিনি সুশীল নন। পৃথিবীর বহু গণতন্ত্রেই সুশীল সমাজের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে–কমে; অসন্তোষ থাকে। কিন্তু কোনো দেশে সুশীল সমাজ ব্যাপারটাই ব্যাপকভাবে একটা গালিতে পরিণত হয়েছে কি না, তা জানা নেই। অন্তত গবেষণা জার্নাল, পত্রিকার আর্কাইভ ও ইন্টারনেট ঘেঁটে এমন কোনো নজির পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে আমরা সবাই জানি ‘সুশীল’ ব্যাপারটা গালিতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু এটা কীভাবে হতে পারল সে সম্পর্কেও কোনো গবেষণা খুঁজে পাইনি। ফলে এ ব্যাপারে সমাজ ও রাজনীতিবিজ্ঞানের পরিসরে গবেষণা হওয়াটা জরুরি।
২০১৬ সালে সর্বপ্রথম বুদ্ধিজীবী হিসেবে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জনপরিসরে এটা চিহ্নিত করেন যে সুশীল সমাজ কথাটি একটা গালিতে পরিণত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘যাদের প্রতি গণমানুষের অগাধ বিশ্বাস-ভরসা, যারা মানুষের কল্যাণার্থে সব সময় নিজেদের নিয়োজিত রাখার কথা, দেশের স্বার্থে জাতির স্বার্থে যাদের আপসহীনভাবে কাজ করার কথা, সেই “কথিত সুশীল সমাজ”ও আজ বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে “সুশীল সমাজ” কথাটিও এখন গালিতে পরিণত হয়েছে।’ সাংবাদিক হিসেবে সেমিনারটি কাভার করার সুযোগ হয়েছিল আমার। সুশীল সমাজকে সাধারণত একটা অরাজনৈতিক সত্তা হিসেবে কল্পনা করা হয়। অরাজনৈতিক মানে কোনোই রাজনীতি থাকবে না এমন নয়, একধরনের মতাদর্শিক ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের রাজনীতি তো সুশীল সমাজের থাকেই; এখানে অরাজনৈতিক বলতে বরং বোঝানো হচ্ছে, দলীয় রাজনীতির পক্ষপাতিত্ব এড়িয়ে চলা। রাজনৈতিক দলগুলোরও অর্গানিক বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী থাকতে পারে, সুশীল সমাজে তাদের যাতায়াতও থাকতে পারে, এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আস্থার সংকট হয় যখন নিরপেক্ষতার ভান করে ক্ষমতার উদ্দেশ্য সাধন করা হয়। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের প্রতি জনগণের সব সময়ই অগাধ আস্থা ছিল, তা কিন্তু নয়। গণতন্ত্র যেভাবে খুঁড়িয়ে চলেছে, অপরিপক্ব দশায় উপনীত ছিল, তেমনি সুশীল সমাজের ভূমিকাও সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তবু গণতন্ত্রের যেমন একটা পর্যায় ছিল, তেমনি জনমনে সুশীল সমাজেরও একটা স্থান ছিল।
কিন্তু শেখ হাসিনার অধীনে পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুশীল সমাজের প্রতি জনগণের আস্থাও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কারণ, গণতন্ত্র ও সুশীল সমাজের ভূমিকা একে–অপরের পরিপূরক। সুশীল সমাজের প্রতি আস্থার এই চরম অবনতি শেখ হাসিনার শাসনকালের প্রথম মেয়াদের শেষার্ধে শুরু হয় বলে ধারণা করি। যখন তিনি বিরোধীদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিতে শুরু করেন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দিয়ে একটি বিনা ভোটের নির্বাচনের দিকে এগোতে থাকেন এবং সুশীল সমাজ তাদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। বিনা ভোটের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর মানুষ যেমন শেখ হাসিনার সরকারের ওপর পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তেমনি ভুয়া নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ না জানানোয় ও পরবর্তী সময়ে সুশীল সমাজের এক অংশের সরকারের পক্ষে ন্যায্যতা তৈরির প্রচেষ্টার কারণে গোটা সুশীল সমাজকেই জনগণ ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে।
বিগত ১৬ বছরে সুশীল সমাজের একটি অংশ ক্রমাগত অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে ন্যায্যতা তৈরি করে গেছেন। অনেকেই সমালোচনার নামে মৃদু মৃদু কিংবা ‘কুসুম কুসুম’ সমালোচনায় সীমাবদ্ধ থেকেছেন। একনায়কতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একদিকে দেশের সব ভালো কিছুর কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর জন্য দাবি করা হয়েছে, অন্যদিকে এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করার সময় অনেকে আফসোস করেছেন এই বলে—উনাকে (প্রধানমন্ত্রী) ভুল বোঝানো হয়েছে। এসবই আসলে মতাদর্শিক পক্ষপাতিত্বের নজির। সুশীল সমাজ যখন জনতার পক্ষে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি হবে না, জনতার ন্যায্য স্বার্থকে অগ্রাধিকার না দিয়ে গোষ্ঠীস্বার্থের পক্ষে কাজ করবে, তখন জনতাও সুশীল সমাজের ওপর আস্থা রাখবে না—এমনটাই হওয়ার কথা। মনে রাখা জরুরি, জনতার ভাষা না থাকতে পারে, তবে তাদের একটা তীক্ষ্ণ বোধশক্তি রয়েছে। একটা মজার ব্যাপার হলো, সুশীল সমাজের অনেকে স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে থাকার পরও আস্থার সংকটকে কাজে লাগিয়ে সরকারও সুশীল সমাজকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। ফলে আমরা দেখতে পাই, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা প্রায়ই সুশীল সমাজকে নিন্দামন্দ করেছেন, যাঁরা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের অতি সহজেই দমন করে ফেলেছেন। পাশাপাশি সরকারদলীয় সমর্থকেরা ‘সুশীল’ শব্দটিকে সমানতালে গালি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এটা হয়, কারণ যেকোনো স্বৈরাচারী সরকারই সুশীল সমাজের অস্তিত্বকে হুমকি মনে করে, সুশীল সমাজ যত আনুগত্যই দেখাক না কেন। সুশীল সমাজের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট যে কেবল তাদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার জন্যই হয়েছে, এটা বললে পুরোপুরি সুবিচার করা হবে না। বরং এ ক্ষেত্রে আমাদের মাইক্রোফ্যাসিজম, জনতুষ্টিবাদ ও খারিজ করার সংস্কৃতিরমতো বিষয়গুলোর উত্থানকেও বিবেচনা করতে হবে। এসবের প্রাদুর্ভাব পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই কমবেশি থাকে। ফ্যাসিবাদের কথা যদি ধরি, ফ্যাসিবাদকে সাধারণত আমরা একটা সংগঠন, সরকার বা রাষ্ট্র হিসেবে বা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিষয় হিসেবে দেখি। হিটলার-মুসোলিনির মতো ফ্যাসিস্টদের পতনের পর আমাদের মনে হতে পারে ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদ হারিয়ে গেছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ আসলে সংগঠিত আকারে নতুন নতুন রূপে আবার হাজির হওয়ার সম্ভাবনা সহকারেই সব সময় বিরাজ করে। ফরাসি মনোবিশারদ ফেলিক্স গুয়াতারি দেখান, ফ্যাসিবাদ একটা সাংগঠনিক আকার হিসেবে হাজির হওয়ার আগে তা আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে, সংস্কৃতিতে ও ব্যক্তিসত্তার মতো ক্ষুদ্র পরিসরেও প্রবলভাবে বিরাজ করে। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটি ফ্যাসিবাদী সত্তা আছে এবং আমরা প্রত্যেকেই ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে চাই। ক্ষুদ্র পরিসরে ক্রিয়াশীল ফ্যাসিবাদের এই ধরনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গুয়াতারি সর্বপ্রথম মাইক্রোফ্যাসিজম কথাটির প্রবর্তন করেন। পরবর্তী সময়ে দেল্যুজ ও গুয়াতারি তাঁদের রচনাবলিতে এ নিয়ে আলোচনা করেন।
মানুষ যখন নিজের বিশ্বাসকেই একমাত্র সত্য জ্ঞান করে, তার মতাদর্শ সবাই গ্রহণ করবে—এ অভিপ্রায় পোষণ করে, কেবল নিজের মতের পক্ষে যায় এমন কথা শোনার জন্য আগ্রহী থাকে এবং বিপক্ষে যায় এমন চিন্তা ও মতামতের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তখন কেউ ন্যায়সংগত ও নির্মোহ অবস্থান নিলেও সেটিকে গ্রহণ করতে রাজি থাকে না। এটাই মূলত ফ্যাসিবাদের মূল কথা।সমাজে এ রকম মনোভাব যখন প্রবল আকার ধারণ করে, তখন জনতুষ্টিবাদেরও প্রাবল্য দেখা দেয়। একধরনের বুদ্ধিজীবী, লেখক, অ্যাকটিভিস্ট ও ভাষ্যকারের আবির্ভাব ঘটে, যাঁরা জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে—এমন ধ্যানধারণারই কেবল প্রচার করেন। বাংলাদেশে এটা এখন একটা অনস্বীকার্য বাস্তবতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেটের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ফ্যাসিবাদী আকাঙ্ক্ষারও ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। একই সঙ্গে এসব আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত করার পদ্ধতি-পন্থাও সহজ হয়ে উঠেছে। জনতার ফ্যাসিবাদী আকাঙ্ক্ষা যে কেবল রাজনৈতিক বিষয়াদিতে সীমাবদ্ধ থাকে, তা–ও কিন্তু নয়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদেরও ব্যাপক প্রাবল্য লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা সত্য যে সুশীল সমাজ জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করবে, তবে এটাও মনে রাখা জরুরি যে জনতার সব আকাঙ্ক্ষা যুক্তিসংগত থাকে না৷ এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে জনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাল না মিলিয়ে জনতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। কিন্তু জনপ্রিয়তালোভীরা জনতুষ্টির পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েন বলে যাঁরা নির্মোহ থাকতে চান, তাঁদের কোনো অবস্থানই থাকে না। বরং অন্যায্য আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত না করায় জনতা তাঁদের শত্রু জ্ঞান করে। ফলে অবধারিতভাবে ‘সুশীল’ হয়ে ওঠে একটি গালির নাম।এখানে আরও একটি বিষয় আমাদের বিবেচনা করতে হবে। সেটি হচ্ছে, আমাদের সুশীল সমাজ গড়ের ওপর কখনো জনতার মনের ভাষা, বিশ্বাস, আবেগ ও অনুভূতিকে বোঝার চেষ্টা করেনি। একই সঙ্গে সুশীল সমাজ যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষা জনতার সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারেনি। একে-অপরের ভাষাকে বুঝতে পারা, যোগাযোগ স্থাপন করা, বিশেষ করে সুশীল সমাজের জনতাকে ধারণ করা ও সমাজকে বহিরাগতের দৃষ্টিতে না দেখে সমাজের একজন হিসেবে দেখতে পারাটা খুবই জরুরি। শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় যে অমিত সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, সেখানে সুশীল সমাজের শক্তিশালী ভূমিকা পালন করাটা অপরিহার্য। তবে সামাজিক মেরুকরণ ও আস্থার সংকট বিরাজ করতে থাকলে সেটা করাটা অত্যন্ত কঠিন হবে। ফলে জনগণের আস্থা অর্জনে সুশীল সমাজকে জনতার স্বার্থ ও অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে সত্যিকার ভূমিকাটা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে প্রবলভাবে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদকে শনাক্ত করে তার উপশমে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
রেফারেন্স:
১. Brown, L. D., and Jagadanda, 2005, ‘Civil Society Legitimacy and Accountability: Issues and Challenges’, CIVICUS, Washington, D.C.
২. Genosko, Gary, 2017, ‘Black Holes of Politics: Resonances of Microfascism’, LA DELEUZIANA – ONLINE JOURNAL OF PHILOSOPHY – ISSN 2421-3098 N. 5 / – EARTH-REFRAIN WAR MACHINES 59
৩. Tom, 2016, ‘DIGITAL FACE-ISM AND MICRO-FACISM’, THE OFFICIAL: International Journal of Contemporary Humanities, Vol. 1, No. 1
৪.https://carnegieendowment.org/posts/2019/02/civil-society-legitimacy-in-question-defamation-patterns
৫.https://www.google.com/amp/s/www.illiberalism.orgjack-z-bratich-on-microfascism/%3famp
৬.https://givingcompass.org/article/examining-civil-society-legitimacy