শ্রমিকেরা বলছেন, নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্যে বর্তমান মজুরিতে তাঁদের চলছে না। এ অবস্থায় মালিকপক্ষের কম মজুরি প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন অনেকে। আধা পাকা বাসায় দুটি ছোট্ট কক্ষে স্বামী, দুই ছেলে-মেয়ে আর শাশুড়িকে নিয়ে থাকেন পোশাকশ্রমিক মোসাম্মত ফারজানা। তিনি একটি পোশাক কারখানায় বেশ কয়েক বছর ধরে অপারেটর পদে কাজ করছেন। গত মাসে ওভারটাইমসহ বেতন পেয়েছেন ১৫ হাজার টাকা। তাঁর স্বামী ভ্যান চালান।
মোসাম্মত ফারজানা বলেন, দুই কক্ষের ভাড়া দিতে হয় তিন হাজার করে ছয় হাজার টাকা। বিদ্যুৎ বিল আছে ৩০০ টাকা। ছেলে ও মেয়ের পড়াশোনার খরচ আছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সংসার চালানোই কঠিন। এক কেজি পেঁয়াজের দাম ১২০ টাকা। আলু ৬০-৭০ টাকা। এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলেও বাজার করা যায় না। প্রতি মাসে মুদিদোকানে বাকি থাকছে।
ফারজানার মতো অধিকাংশ পোশাকশ্রমিকই বর্তমান মজুরিতে সংসার চালাতে পারছেন না। নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ২৩-২৫ হাজার টাকা মজুরি দাবি ও নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠনে আশাবাদী হয়েছিলেন পোশাকশ্রমিকেরা। কিন্তু মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরি প্রস্তাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তাঁরা। ‘মজুরি বাড়ানো নিয়ে মজুরি বোর্ডে আলোচনা হচ্ছে। সেই আলোচনার পর সরকার মজুরি চূড়ান্ত করার পর তা না মেনে আন্দোলন হলে একটি যুক্তি ছিল। কিন্তু বর্তমান আন্দোলনের কারণ আমরা বুঝতে পারছি না।’
ফারুক হাসান, বিজিএমইএর সভাপতি
ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার বেশ কয়েকজন পোশাকশ্রমিক ও শ্রমিকনেতার সঙ্গে কথা বলে শ্রমিকদের ক্ষোভের দুটি কারণই মূলত জানা গেছে। একটি বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দাম, অন্যটি মজুরি বোর্ডে মালিকদের কম মজুরি প্রস্তাব। তাঁরা বলছেন, বাজারে নিত্যপণ্যের যে দাম, তাতে বর্তমানে কোনোরকমে খেয়ে–পরে বেঁচে থাকতেই কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা মজুরি দরকার। গত ২২ অক্টোবর বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব দেন। বিপরীতে মালিকপক্ষ প্রায় অর্ধেক মজুরির প্রস্তাব দেয়। তাতে ২৩ অক্টোবর থেকে গাজীপুরে শ্রমিকেরা আন্দোলন নামেন। সেই অসন্তোষ ছড়িয়েছে আশুলিয়া-সাভারেও। গত সোমবার দুজন পোশাকশ্রমিক নিহত হন। এরপর গতকাল আন্দোলন আরও সহিংস হয়ে ওঠে। গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানা অনিবার্য কারণ দেখিয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে।
এদিকে শ্রমিক আন্দোলন দমাতে চলতি সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বারস্থ হন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা। শ্রম প্রতিমন্ত্রী শ্রমিকদের গুজবে কান না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। নিম্নতম মজুরি বোর্ড সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, মজুরি হার চূড়ান্ত হয়নি, আলোচনা চলমান রয়েছে। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় গতকাল নিজেদের কার্যালয়ে বিজিএমইএর নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, শ্রমিকেরা যদি কাজ না করেন বা কারখানা থেকে বের হয়ে যান, তাহলে মালিকেরা শ্রম আইন অনুযায়ী কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন। অর্থাৎ কারখানায় কাজ না করলে শ্রমিকেরা মজুরি পাবেন না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, মজুরি নিয়ে শ্রম অসন্তোষ ও শ্রমিক নিহতের ঘটনার সম্পূর্ণ দায় মালিকদের। মজুরি বাড়ানো নিয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নামা পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করতে হবে। পেঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা। আলু ৭০ টাকা কেজি। ডিমের দামও নাগালের বাইরে। এগুলো তো বানানো গল্প না। সবাই জানেন। তাহলে বর্তমান মজুরিতে শ্রমিকেরা কীভাবে বাঁচবেন।
২০ দিনের পর চলতে পারি না
রাজধানী থেকে গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় বাইপাইলে পৌঁছে জামগড়ার দিকে এগোতেই দেখা গেল, কয়েকজন তরুণ লাঠিসোঁটা নিয়ে একটি কারখানার ফটকে হামলা করছেন। এই তরুণদের হঠাৎ ২৩ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে স্লোগান দিতে দেখা গেল।
স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিকনেতা জানালেন, এবারের আন্দোলনে শ্রমিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন। তবে হামলা-ভাঙচুরের সঙ্গে শ্রমিকেরা জড়িত নন।
জামগড়া বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে ভাদাইল এলাকায় বেলা সাড়ে ১১টায় গিয়ে কথা হয় পোশাকশ্রমিক মো. লালন মিয়ার সঙ্গে। একটি কারখানায় অপারেটর পদে কাজ করেন তিনি। তাঁর মাসিক মজুরি ১১ হাজার ৩০০ টাকা। ওভারটাইমসহ মাসে ১৪ হাজার ৫০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পান।
লালন মিয়া স্ত্রী ও দুই বছরের সন্তান নিয়ে এক কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। মাসে ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ বিল দেন ৩০০ টাকা। রান্নাঘর ও বাথরুম আরও দুই পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হয়। লালন মিয়া বললেন, ‘যে মজুরি পাই, তা দিয়ে ২০ দিনের বেশি চলতে পারি না। প্রত্যেক মাসেই ধারদেনা করতে হয়।’
লালন মিয়ার সঙ্গে কথা শেষে পোশাকশ্রমিকেরা থাকেন এমন একটি বাড়িতে যাই। ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দুই পাশে সারি সারি ঘর। সেখানে একটি ছোট্ট ঘরে থাকেন মরিয়ম বেগম। তিনিও একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর পদে কাজ করেন। ওভারটাইমসহ গত মাসে মজুরি পেয়েছেন সাড়ে ১০ হাজার টাকা। তাঁর স্বামী ভাঙারির ছোট্ট ব্যবসা করেন।
মরিয়ম বেগম বলেন, মাস শেষে বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ ও ময়লা বিল বাবদ বাড়িওয়ালাকে ৩ হাজার ২৫০ টাকা দিতে হয়। বাকি টাকায় দুজনের মাসের খাওয়া খরচও হয় না।
মরিয়ম বেগমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন আশপাশের আরও কয়েকজন পোশাকশ্রমিক জড়ো হন। তাঁরা জানান, ১০-১২ হাজার টাকা মজুরি দিয়ে বর্তমানে বাজারে বেঁচে থাকা যাবে না। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য সর্বপ্রথম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয় ১৯৯৪ সালে। তখন সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৯৩০ টাকা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে মজুরি বেড়ে হয় ৮ হাজার টাকা।
শ্রমিকনেতারা বলছেন, ২০১৮ সালে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। সে হিসাবে তখন নিম্নতম মজুরি ছিল ৮ হাজার টাকা বা ৯৫ ডলার ৩৫ সেন্ট। এখন ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। ডলারের বিনিময় হার হিসাব করলেই আগের মজুরি বেড়ে এখন ১০ হাজার ৫৩৬ টাকা হওয়ার কথা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মজুরি বোর্ডে প্রস্তাব দেওয়ার আগে বিজিএমইএর নেতারা একাধিকবার বিভিন্ন কারখানার মালিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। মালিকদের একাংশ ১২ হাজার টাকা মজুরি দেওয়ার সক্ষমতার কথা জানান। কেউ কেউ বলেন, সাড়ে ১২ হাজার টাকা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মজুরি বোর্ডে প্রাথমিকভাবে ১১ হাজার ২০০ টাকা মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে পোশাকশিল্পের প্রভাবশালী একটি মহল ১০ হাজার ৪০০ টাকার প্রস্তাব দেওয়ার পক্ষে মত দেয়।
মালিকপক্ষের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মজুরি প্রস্তাব আরও কিছু বেশি দিলে শ্রমিকেরা হয়তো এতটা ক্ষুব্ধ হতেন না।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘মজুরি বাড়ানো নিয়ে মজুরি বোর্ডে আলোচনা হচ্ছে। সেই আলোচনার পর সরকার মজুরি চূড়ান্ত করার পর তা না মেনে আন্দোলন হলে একটি যুক্তি ছিল। কিন্তু বর্তমান আন্দোলনের কারণ আমরা বুঝতে পারছি না।’
ফারুক হাসান আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের আন্দোলন ও ভাঙচুরের মধ্যে মালিকেরা কারখানা চালু রাখতে চাচ্ছেন না। আমরা তাঁদের চালু রাখতে অনুরোধ করছি। আজ বুধবার বিজিএমইএর কার্যালয়ে মালিকদের সঙ্গে জরুরি সভায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’