টাঙ্গাইল, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস): স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য হওয়ার। চাকুরি করে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার। স্কুল ছাত্র মারুফ মাকে প্রায়ই বলতো, ‘লেখাপড়া শেষ করে আমি চাকুরি পেলে তোমার আর চিন্তা থাকবে না’।কিন্তু মারুফের সে স্বপ্ন পুরণ হলো না। পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে সব কিছুই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। গত ৫ আগস্ট টাঙ্গাইলে ছাত্র আন্দোলনের বিজয় মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে আর ফেরা হয়নি মারুফের।
পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। বাবা-মায়ের ভবিষ্যত স্বপ্ন একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পরিবারে এখন নেমে এসেছে অন্ধকার।বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ মারুফ মিয়া(১৪) টাঙ্গাইল শহরের শাহীন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তিনি টাঙ্গাঈল পৌরসভার সাবালিয়া নিবাসী মজনু মিয়া (৪৫) ও মোর্শেদা আক্তার (৩৬) দম্পতির পুত্র। দুই ভাই বোনের মধ্য মারুফ বড়। ছোট বোন সানজিদা আক্তার (১২) একই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী।
সরেজমিনে শহরের সাবালিয়ায় মারুফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আদরের সন্তানের স্কুল ব্যাগ, পরনের কাপড়, জুতো আর পারিবারিক ছবি আগলে বসে আছেন হতবিহ্বল মা মোর্শেদা আক্তার। এসব কিছুর মধ্যেই ছেলে মারুফকে খুঁজে চলেছেন তিনি। ভাইয়ের কথা মনে করে সারাক্ষণই ছোট বোনের চোখ ছলছল করছে। বাবা মজনু মিয়া কয়েকমাস আগেই সৌদি গিয়েছেন জীবিকার তাগিদে।
সন্তানের মৃত্যু সংবাদে দিশেহারা বাবা এখনই দেশে আসতে পারছেন না। উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় দিন কাটছে তার। মারুফের মৃত্যুর প্রায় দেড় মাস কেটে গেলেও থামছে না মায়ের কান্না।অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে মোর্শেদা আক্তার বাসসকে বলেন, ৫ আগস্ট আমার সাথেই দুপুরের খাবার খায় মারুফ। খাওয়া শেষ করে বন্ধুদের সাথে বিজয় মিছিলে যায়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বিজয় মিছিল টাঙ্গাইল সদর মডেল থানার কাছে পৌঁছালে পুলিশ গুলি চালায়।
এতে একটি গুলি মারুফের মাথায় লাগে। মারুফ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহপাঠিরা মারুফকে টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আমাকে পরিচিত একজন মোবাইল থেকে ফোন করে জানায়, মারুফ পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।পরদিন টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠে নামাজে জানাজা শেষে মারুফের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকি ইউনিয়নের জশিহাটি গ্রামে দাফন করা হয়।
তিনি আরো জানান, ভাগ্য বদলের আশায় ধারদেনা করে মারুফের বাবা চার মাস আগে সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছেন। তার আয়েই সংসার চলে। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে আর্থিক সংকটে কোন ভাবে দিন চলে যাচ্ছে। একমাত্র ছেলে মারুফকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন ছিলো। বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার ইচ্ছে ছিলো মারুফের। মারুফ নেই। এখন একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যত নিয়েই যত চিন্তা।
মারুফের বাবা মজনু মিয়া দেশে ফিরে যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারেন সেজন্য সরকারের কাছে মারুফের বাবার জন্য একটি চাকুরির ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান মোর্শেদা আক্তার। এছাড়াও তিনি কুমুদিনী সরকারি কলেজ গেট থেকে স্টেশন সড়কটি মারুফের নামে নামকরণ করার দাবি জানান।মারুফের ছোট বোন সানজিদা আক্তার বলেন, ‘আমার ভাই আমাকে অনেক ভালবাসত।
ও যে এ দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেছে আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবে না এটা আমি ভাবতে পারি না। যারা আমার ভাইকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে আমি তাদের বিচার চাই।’প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর আলম জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই মারুফ এতে জড়িয়ে পড়ে। খুবই ন¤্রভদ্র মারুক এলাকায় দেয়াল লিখনের মাধ্যমে আন্দোলনে সক্রিয় ছিল।
ছাত্র হিসেবেও ভাল ছিল মারুফ।বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টাঙ্গাইলের অন্যতম সমন্বয়ক আল আমিন বলেন, ‘টাঙ্গাইলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মোট শহিদ হয়েছেন ৯ জন। আর আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধ শতাধিক। এর মধ্যে ১৭ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে অন্দোলনে টাঙ্গাইল সদর মডেল থানার সামনে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন মারুফ মিয়া। এ অন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাকী ৮ জন শহিদ হন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে। তিনি বলেন, এই গণঅভ্যুত্থানে যারা শহিদ এবং আহত হয়েছে তাদের পরিবারের যেকোনো প্রয়োজনে সব সময় পাশে থাকবো।
জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত মারুফের পরিবারকে সান্ত¦না দিতে ঘটনার পর থেইে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সেনাবাহিনীর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের লোকজন মারুফের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে সাধ্যমত নানাভাবে সহযোগিতাও করা হয়। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে মারুফের পরিবারকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে ।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক বাসস কে জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় মিছিলে মেধাবী স্কুলছাত্র মারুফ মিয়া নিহতের ঘটনা খুবই মর্মস্পর্র্শী। এ ঘটনার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার তার বাড়িতে গিয়ে সান্ত¡না দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নানাভাবে সামান্য সহযোগিতাও করা হয়েছে। এছাড়াও সরকারিভাবে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহতের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা এবং আহতদের একলাখ টাকা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মারুফের পরিবার যাতে এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসন লক্ষ্য রাখবে।
এ সংক্রান্ত চিঠি আসলে আমরা মারুফের পরিবারকে তা পৌঁছে দেব।উল্লেখ্য, মারুফ হত্যার ঘটনায় মারুফের মা মোর্শেদা আক্তার বাদী হয়ে সাবেক কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম, পৌরসভার মেয়র সিরাজুল হক আলমগীরসহ ৫৬ জনকে আসামী করে টাঙ্গাঈল সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন।