বিলুপ্তপ্রায় ও দুর্লভ প্রজাতির গাছের প্রজনন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ১৯৬৮ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরে ৪২৫ একর বনভূমিজুড়ে গড়ে তোলা হয় চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্র। শুরুতে ছিলেন ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। বর্তমানে আছেন মাত্র ৪ জন। সেই সঙ্গে বরাদ্দও কমে গেছে জনবলসংকট, বরাদ্দের অপ্রতুলতা, গবেষণাকাজ সংকুচিত হওয়া, কর্মস্থলের জরাজীর্ণ অবস্থাসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় ধুঁকছে একসময়ের দেশের সবচেয়ে বড় এই বন গবেষণা কেন্দ্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনকালীন একজন গবেষণা কর্মকর্তা, একজন রেঞ্জ কর্মকর্তা, একজন ডেপুটি রেঞ্জার, একজন সিড ম্যানেজমেন্ট অফিসার, একজন নার্সারি সুপারভাইজার, বন প্রহরী, নার্সারি অ্যাটেনডেন্ট, অফিস সহায়কসহ ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী পদায়ন করা হয়। ওই সময়ে দুই শতাধিক দুর্লভ এবং বিলুপ্তপ্রায় গাছ ও গুল্মলতা নিয়ে কার্যক্রম চলমান ছিল। এই গবেষণাকেন্দ্রের গবেষণাকর্ম দেশি বিদেশি জার্নালেও স্থান করে নিয়েছিল। এই কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্রটি দেশের বৃহত্তম বন গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়।
বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়েক দশক ধরে মধুপুর বন উজাড় হচ্ছে। মূলত ৮০ থেকে ৯০ দশকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, অসাধু বন কর্মকর্তা, পুলিশ প্রশাসন ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন মিলে অবাধে মধুপুর বনের গাছ কেটে নেয়। এমনকি চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে লাগানো গাছপালাও কেটে ধ্বংস করে বনদস্যুরা। চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্রের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বনদস্যুরা চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্র ধ্বংসে মেতে উঠেছিল। গবেষণাকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আটকে রেখে গাছ লুটের ঘটনাও ঘটেছে। এভাবেই বন গবেষণা কেন্দ্রটিও বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ে। পরে প্রভাবশালীরা দখল করে নেয় বনভূমি। বর্তমানে ৫৫ একর এলাকা চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্রের আওতায় রয়েছে। সম্প্রতি সরেজমিনে চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, গবেষণাকেন্দ্রের প্রবেশপথে রয়েছে দুর্লভ সিদা জারুল, রক্তচন্দন, আগর, আমলকী, বহেড়া, হরীতকী, সোনালু, দারমারা, বেত, পীতরাজ, অর্জুন, সিদুগাছ। প্রবেশপথ বরাবর নার্সারি।
নার্সারির চারা তৈরির অধিকাংশ বেড ফাঁকা। নার্সারিজুড়ে ১০-১৫ প্রজাতির গাছের চারা শোভা পাচ্ছে। নার্সারির ডান দিকে আবাসিক এলাকা। বাঁ দিকে বন গবেষণা কেন্দ্রের কার্যালয়। ইটের প্রাচীরের ওপর টিনশেডের ছাউনির কার্যালয়টি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বেহাল নার্সারি শেডও। কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজিজুল হক বসে আছেন। তাঁর সামনে আরও তিন কর্মকর্তা। বীজ সংগ্রহ, নার্সারি প্রস্তুত, চারা উত্তোলন, সম্প্রসারণ—সবই করতে হয় তাঁদের। গবেষণাকেন্দ্রের পাঁচটি আবাসিক ভবনের সব কটিই পরিত্যক্ত, ব্যবহারের অনুপযোগী। বাধ্য হয়ে সেখানেই বসবাস করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কথা হলে গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজিজুল হক বলেন, ‘আমি যে চেয়ারে বসে আছি, সেটিও নিজের টাকায় কেনা। কিছুদিন আগে অল্প কিছু টাকা পাইছিলাম, তাই দিয়া ভাঙা ঘরের ফ্লোরে টাইলস লাগাইছি। বরাদ্দ চাইলেও পাই না, কষ্টের কথা কারে কমু।’ তবে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গবেষণাকেন্দ্রে বছরে ১০ হাজার চারা উৎপাদিত হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা। বীজ সংগ্রহকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, গবেষণাকেন্দ্রে লাগানো বিরল প্রজাতির গাছগুলো থেকে বীজ সংগ্রহের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থান থেকে উন্নত প্রজাতির বীজ সংগ্রহ করে চারা উৎপাদন করা হয়।
ডেপুটি রেঞ্জ কর্মকর্তা অমরেন্দ্র নারায়ণ সরকার বলেন, ‘আমরা বনের মধ্যে থাকি, কিন্তু নেই বনপ্রহরী। নিরাপত্তার জন্য সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করেই আমাদের দিনরাত কাটে।’ মধুপুরের শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ বজলুর রশীদ খান চুন্নু বলেন, ‘ভবিষ্যৎ অগ্রগতির জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। মধুপুরে বন গবেষণা কেন্দ্র যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে।’ বাংলাদেশ বন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক যুগ্ম সচিব এ কে এম শওকত আলম মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি পরিদর্শন না করে কোনো কিছু বলতে পারছি না। আগে পরিদর্শন করি, পরে বিস্তারিত জানতে পারবেন।’