গত মাসের ২১ তারিখ রাতের বৃষ্টিতে যাঁরা রাজধানীর রাস্তায় ছিলেন, তাঁদের অনেকে এখন বৃষ্টি দেখলে আতঙ্কে ভোগেন। সেই রাতের বৃষ্টিতে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা ও যানজটে আটকে পড়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন হাজারো মানুষ। সেদিন জলাবদ্ধ রাস্তায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন। বৃষ্টি হলেই ঢাকার ট্রাফিক-ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়ে, তা সবার জানা। বৃষ্টি মানেই তীব্র যানজট, চরম ভোগান্তি।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতের বৃষ্টিতেও সেই ভোগান্তি আর কষ্ট হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন নগরবাসী। তাঁদের একজন সরকারি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাজেদা আক্তার। গতকাল কর্মস্থল থেকে বাসায় যেতে তাঁর সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লেগে যায়। তেজগাঁও এলাকায় এক জায়গায় দুই ঘণ্টা ও মহাখালীতে এক ঘণ্টা তাঁকে বহনকারী বাস আটকে ছিল। অন্য সময় বিকেলে বাসায় ফিরতে তাঁর গড়ে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। বৃষ্টিতে বারবার যানজট ও ঢাকাবাসীর ভোগান্তির কারণ রাস্তায় দীর্ঘসময় ধরে থাকা মানুষদের কাছে জানতে চান এই প্রতিবেদক। প্রশ্নের উত্তরে ভিন্ন ভিন্ন কারণের কথা বলেন ট্রাফিক পুলিশ, গণপরিবহনের চালকেরা। ট্রাফিক পুলিশ বলেছে, রাস্তায় মোটরসাইকেল রেখে আরোহীদের দাঁড়িয়ে থাকা, ইঞ্জিনে পানি ঢুকে যানবাহন অচল হয়ে পড়া, রিকশা-অটোরিকশার অলিগলিতে ঢুকে পড়ার প্রবণতা যানজটের অন্যতম কারণ। গণপরিবহনের চালকেরা বলছেন, রাস্তার খানাখন্দের কারণে তাঁরা স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালাতে পারেন না। রাস্তায় পানি জমে থাকলে গাড়ি আটকে যায়। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন নাজুক ড্রেনেজ-ব্যবস্থার কথা। ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ বলেন, ঢাকার রাস্তায় বেশি মোটরসাইকেল চলাচল করে। বৃষ্টি শুরু হলে মোটরসাইকেল রাস্তায় রেখে আরোহী কোথাও আশ্রয় নেন। এতে গাড়ি চলাচলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ঢাকার বিভিন্ন সড়কে ভাঙাচোরা থাকায় বৃষ্টির সময় স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চলতে পারে না। ঢাকার অনেক বাজার এলাকায় নিরাপত্তাকর্মী বা বাজার কমিটির লোকজন যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সহায়তা করেন, কিন্তু বৃষ্টির সময় তাঁরা থাকেন না। বৃষ্টির সময় অনেক যানবাহন দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে বিভিন্ন অলিগলি ব্যবহার করে। যেমন-তেমনভাবে অলিগলি ব্যবহার করায়, সেখানে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব ধীরে ধীরে মূল সড়কে গিয়ে পড়ে। অনেক মানুষ গন্তব্যে পৌঁছাতে রিকশায় চলাচল করেন। এসব রিকশা মূল সড়কে গেলে দ্রুতগতির যানবাহনগুলোর গতি কমে আসে।
এ কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশ কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বৃষ্টির সময় বিভিন্ন কারণে গাড়ির গতি কমে যাওয়ার পাশাপাশি ছোট যান, যেমন সিএনজিচালিত অটোরিকশার ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়। সড়কে যানবাহনের ইঞ্জিন বিকল হলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় একটি অঞ্চলের সড়কে যানবাহনের গতি কমে গেলে এর প্রভাব অন্য এলাকাগুলোয়ও পড়ে। ফলে এর প্রভাব ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ট্রাফিক পুলিশকে যানজট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়। রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে জলাবদ্ধ সড়কে আটকে থাকে যানবাহন। ঢাকার ডেমরা থেকে বনশ্রী-রামপুরা-মালিবাগ-শাহবাগ হয়ে মোহাম্মদপুরে চলাচল করে রমজান পরিবহন। আজ শুক্রবার সকালে বনশ্রীতে কথা হয় রমজান পরিবহনের চালক সুমন মল্লিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই রুটে এলিফ্যান্ট রোড ও মালিবাগ এলাকার রাস্তায় ভাঙা এবং খানাখন্দ রয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই এই সড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব তখন অন্য সড়কগুলোয় পড়ে। তখন দেখা যায় এক ঘণ্টার রাস্তা চার ঘণ্টায়ও পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয় না। ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী গণপরিবহনের বেশ কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলছেন, ঢাকার অনেক রাস্তা ভাঙা। কোথাও কোথাও আবার খানাখন্দ আছে। বৃষ্টির সময় এসব খানাখন্দে পানি জমে থাকার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে ধীরে ধীরে গাড়ি চালান তাঁরা। আর রাস্তায় জলাবদ্ধতা তৈরি হলেও স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালানো সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে ভয়াবহ যানজটে পড়তে হয় তাঁদের। সব সমস্যার গোড়া হিসেবে নাজুক ড্রেনেজ-ব্যবস্থার কথা বললেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকার ড্রেনেজ-ব্যবস্থা খুবই নাজুক অবস্থায় আছে। এটি সুপরিকল্পিত নয়। বৃষ্টির পানি সড়কের দুই পাশে সরে গিয়ে ড্রেনে প্রবেশ করার কথা। পানি দুই পাশে সরে যাওয়ার জন্য মাঝখানে একটু উঁচু রাখা হয়। এটাকে বলা হয় ‘ক্যাম্বার’ (সড়কের আড়াআড়ি ঢাল)। ঢাকার ড্রেনেজ-ব্যবস্থা নাজুক হওয়ার কারণে বৃষ্টির সময় রাস্তার দুই পাশে পানি জমা শুরু হয়। এ সময় যানবাহনগুলো রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচল শুরু করে। এতে করে রাস্তার যানচলাচলের সক্ষমতা ৫০ শতাংশ কমে যায়। সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকায় তীব্র যানজটের এটা অন্যতম কারণ। বৃষ্টি বেশি হলে পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নাজুক ড্রেনেজ-ব্যবস্থার কারণে বৃষ্টির সময় পানি দ্রুত সরে যেতে পারে না। ড্রেনেজ-ব্যবস্থার সঙ্গে খাল বা লেকের যে ‘কানেকটিভিটি’, খালের সঙ্গে নদ-নদীর ‘কানেকটিভিটি’ থাকার কথা, সেটি নেই। ফলে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর সমাধান কী, জানতে চাইলে হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকার ড্রেনেজ-ব্যবস্থা এতটাই অপরিকল্পিত, এটা কয়েক দিন পর ভাঙা হয়, আবার সেটি ঠিক করা হয়। দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা করে ড্রেনেজ-ব্যবস্থা তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই। এর সঙ্গে খাল ও নদ-নদীর যোগসূত্র তৈরি করে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে। তা না হলে এর সমাধান সম্ভব নয়। পুলিশের তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের ডিসি মোস্তাক আহমেদ বলেন, বৃষ্টির সময় তীব্র যানজটের পেছনে প্রকৌশলগত কিছু বিষয় আছে।
এগুলো সমাধানের পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক-ব্যবস্থা কার্যকর করা না গেলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আর মানুষের সচেতনতা এখানে খুবই জরুরি। বৃষ্টির সময়ও ট্রাফিক আইন মানতে হবে। বৃষ্টির সময় রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করলে, সেটি অনেক চাপ সৃষ্টি করে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হকও মনে করেন, বর্তমানে ঢাকার সড়কের যে পরিস্থিতি, তাতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক-ব্যবস্থা ছাড়া যানজট নিয়ন্ত্রণ একেবারেই অসম্ভব। আর বৃষ্টির সময় সেই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, বৃষ্টির সময় সড়কে ট্রাফিক পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তিনি বলেন, তিনি যখন আইজিপি ছিলেন, তখন ঢাকার ট্রাফিক-ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় করার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। প্রকল্পটি পাস হওয়ার আগেই তিনি অবসরে যান। তারপর সেই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। সেটি বাস্তবায়ন হলে এই সমস্যা থাকবে না বলে তিনি মনে করেন।