বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক অনুযায়ী বছরের অধিকাংশ সময় অস্বাস্থ্যকর থাকে ঢাকার বাতাস। শীত মৌসুমে যেটা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ হয়ে ওঠে। ঢাকার আকাশ ঢাকে ধূসর ধূলিকণায়। বায়ুদূষণের বিশ্ব তালিকায়ও ঢাকা উঠে আসে শীর্ষে। শেষ কবে নির্মল, বিশুদ্ধ বাতাস ঢাকার মানুষ পেয়েছে সেটা এখন প্রশ্নাতীত। ঢাকার দূষণ রোধে প্রশাসনের সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ইটভাটাগুলো বায়ুদূষণে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে। প্রত্যেকটি ইটভাটা একেকটি ইন্ডাস্ট্রির মতো দূষণ করে যাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচল ও অপরিকল্পিত কনস্ট্রাকশনের কারণে পরিবেশের এই বিপর্যয়।
দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণা অনুযায়ী, নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও শিল্প-কারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া, আন্তর্দেশীয় দূষণ (নেপাল ও ভারত থেকে আসা দূষিত বাতাস), রান্নাঘরের ধোঁয়া ও শহুরে বর্জ্য বায়ুদূষণের বড় উৎস। এছাড়া ঢাকার যেসব এলাকায় বর্জ্য পোড়ানো হয়, সেসব এলাকায়ই বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। ময়লার স্তূপ যেখানে থাকে, সেখানে উৎপন্ন হয় মিথেন গ্যাস।
এই বায়ুদূষণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্টও। দেশের নদ-নদী, রাস্তাঘাট, বাতাস সবকিছু দূষিত এবং ঢাকা খুব বাজে অবস্থায় আছে বলে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। গত ১৮ জানুয়ারি অবৈধ ইটভাটা সংক্রান্ত এক রিটের শুনানিতে হাইকোর্টের বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পায়নের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, তবে সেটা হতে হবে পরিবেশ রক্ষা করে। আমরা সাজা দিতে পারি। কিন্তু সাজা দিয়েই কি সব হয়? আমরা বিব্রতবোধ করি যে, কতবার এসব নিয়ে নির্দেশনা দেবো।’
ক্যাপস চেয়ারম্যান ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামানবলেন, ‘বায়ুদূষণের কারণ, সূত্র সবাই জানি। কিন্তু এর প্রতিকারে সমন্বয় নেই। শহরে সরকারি ১০টি মন্ত্রণালয় ও ৩০-৩৫টি সংস্থা পরোক্ষভাবে বায়ুদূষণের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর বা সিটি করপোরেশন এটার টেকসই সমাধান করতে পারবে না। এজন্য সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।’
সরেজমিনে ঢাকার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নির্মাণাধীন কোনো ভবনেই মানা হচ্ছে না আইন। যত্রতত্র ফেলে রাখা হচ্ছে নির্মাণসামগ্রী। কোথাও দেখা যায়নি ছাউনি বা ঢাকনাজাতীয় কিছু। একই অবস্থা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রেও। সেখানেও নেই নির্দেশনা মানার বালাই। এসব জায়গা থেকে ধুলা মিশে যাচ্ছে ঢাকার বাতাসে।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট এলাকায় ছয়মাস ধরে কাজ চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের। সেখানে কোনো রকম বেষ্টনী ছাড়াই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করতে দেখা যায়। এছাড়া মোহাম্মদপুর, বাবুবাজার রোড, পোস্তগোলা, জুরাইন রাস্তা সংস্কারে নির্দেশনা মানতে দেখা যায়নি।
বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ বিধিমালা-২০২২-এ বলা হয়েছে, ‘বর্জ্য বা উহার কোনো অংশ যত্রতত্র খোলা অবস্থায় সংরক্ষণ বা পোড়ানো যাবে না। নির্মাণাধীন স্থানে নির্মাণসামগ্রী (মাটি, বালি, সিমেন্ট, ইট, ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি) ছাউনি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এসব সামগ্রী পরিবহনের সময় ব্যবহৃত ট্রাক, ভ্যান বা লরি সম্পূর্ণরূপে ঢেকে পরিবহন করতে হবে।’
তবে এসব নির্দেশনা মানছে না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। নির্দেশনা মানাতে পরিবেশ অধিদপ্তরের যে মনিটরিং রয়েছে সেগুলোও পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্টের হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু রাজধানীতে নির্মাণসামগ্রী দ্বারা বায়ুদূষণের দায়ে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগ। এছাড়া এসময় ঢাকার আশপাশে ছয়টি অবৈধ ইটভাটায় অভিযান ও নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রির দায়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। তবে দূষণের তুলনায় এসব অভিযানকে যথার্থ মনে করছেন না পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা।
ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরিফ জামিল বলেন, ‘ঢাকার বায়ুদূষণ এখন মহামারির চেয়ে কম নয়। এই যে বড় বিপর্যয় হচ্ছে, সরকার এর গুরুত্ব অনুধাবন না করাটাই দূষণ না কমার সবচেয়ে বড় কারণ। আমি মনে করি সরকারের যারা দায়িত্বশীল রয়েছেন তারা জনগণের প্রতি অবহেলা করছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের কিন্তু আইন রয়েছে, সেটি মানা হচ্ছে না। এটা মানার জন্য যে ক্যাপাসিটি দরকার সেটিও তাদের নেই। শীতে যে পরিমাণ দূষণ হচ্ছে এর উৎসগুলো খুঁজে প্রতিরোধ করতে পারছে না তারা। এক্ষেত্রে অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি সিটি গভর্ন্যান্স ও নাগরিকের কর্তৃত্ব, বিআরটিএ, বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিসহ সবার সমন্বয়ে দূষণ রোধ করতে হবে।’
এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভসের পরিচালক মুনির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমি মনে করি ঢাকা শহরের অধিক জনসংখ্যা বায়ুদূষণে অনেক প্রভাব ফেলে। আমরা যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করি, সেগুলো কোথায় যাবে। অর্থাৎ, যত সংখ্যক জনগণ রয়েছে, সে অনুযায়ী গাছগাছালি নেই।’
‘এই যে যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তা কাটা হচ্ছে এতে অনেক বেশি ধুলা এসব জায়গা থেকে মাসের পর মাস বাতাসের সঙ্গে মিশছে। উন্নত দেশগুলোতে রাস্তা কাটলে পরের দিন বোঝা যায় না যে রাস্তার কোন অংশ কাটা হয়েছে। আমি মনে করি এ রাস্তা কাটাকাটি, নির্মাণ, প্রকল্পে যারাই জড়িত সবার কিন্তু দায়বদ্ধতা রয়েছে।’
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনের শাসন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে আসলে আইনের শাসন নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর এ জিনিসটা করতে পারছে না। বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি নিয়ে শুধু রাস্তা কাটাকাটি করে দু-তিন বছর পর্যন্ত। ততদিন ধুলা উড়তে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অধিদপ্তরকে তাদের আইন মানাতে বাধ্য করতে হবে। এটাই সবচেয়ে জরুরি।’
মানবাধিকার ও পরিবেশকর্মী ফাদার জোসেফ গোমেজ বলেন, ‘শীতকালে কুয়াশা থাকার কারণে বায়ু ওপরে যেতে পারে না। এটি নিচেই থেকে যাচ্ছে। ফলে শীতকালেই সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। এক্ষেত্রে আসলে সরকারের পদক্ষেপের প্রতি আশা করা যায় না।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং এনফোর্সমেন্ট শাখার উপ-পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ কবির বলেন, ‘ঢাকা শহরে হাজার হাজার বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। অনেক মেগা প্রজেক্ট চলছে। সব জায়গায় তো আমাদের লোকবল যাওয়া সম্ভব নয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিটি ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরাও সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। আমরা বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিদিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। বায়ুদূষণের অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে সচেতন হতে হবে। সিটি করপোরেশনকে তার সঠিক কাজ করতে হবে।’
সিটি করপোরেশনের দাবি দূষণ কমেছে। যদিও এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে একদিনও ঢাকার মানুষ স্বাস্থ্যকর বাতাস পায়নি। সূচক ১৯৪ এর নিচে নামেনি কোনোদিন। ৫০ এর নিচে থাকলে সেটাকে ভালো বাতাস বলে গণ্য করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ডাস্ট সুইপার তো সব সময় কাজ করে যাচ্ছে। আর আগের চেয়ে ধুলা অনেক কমেছে। আমরা সব সময় মনিটরিং করে যাচ্ছি। যারা আমাদের থেকে অনুমতি নিয়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে বা ভবণ নির্মাণ করে তাদের সময় বেঁধে দেই, নির্দেশনা মানার কথা বলি। নির্দেশনা না মানলে আমরা শাস্তিও দেই।’