টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব ফ্যাসিবাদি সরকারের দালালমুক্ত করতে নির্যাতিত ও বঞ্চিত সাংবাদিকদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। তারই অংশ হিসেবে বর্তমান কমিটিকে দেয়া আল্টিমেটাম শেষ হচ্ছে সোমবার রাত নয়টায়। এর মধ্যে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষনা করা না হলে আন্দোলরত সাংবাদিকরা পরবর্তী কর্মসুচি ঘোষনা করবে।
জানা গেছে, গত ৫ আগষ্ট দুপুরে আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট সরকারের পতনের খবর পাওয়ার সাথে সাথে বিগত দিনে এই কমিটি দ্বারা নির্যাতিত ও বঞ্চিত সাধারণ সাংবাদিকরা প্রেসক্লাবে গিয়ে উপস্থিত দুইজন সুবিধাভোগী সাংবাদিককে প্রেসক্লাব থেকে বিতারিত করে প্রেসক্লাবে তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরে জেলায় কর্মরত বিভিন্ন বয়োজৈষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের অনুরোধে ওই রাতেই প্রেসক্লাবের তালা খুলে দেয়া হয়। তারপর থেকে অদ্যবধি আওয়ামী ফ্যাসিবাদি সরকারের পদলেহনকারী সাংবাদিকদের নিয়ে গঠিত বর্তমান কমিটি ভেঙ্গে না দিয়ে কমিটি রক্ষায় নানাবিধ টালবাহানা করে আসছে।
আরো জানা গেছে, গত ৫ আগষ্ট রাতে আওয়ামী লীগে নেতাদের আশির্বাদপুষ্ট বর্তমান সভাপতি জাাফর আহমেদ সকল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমি স্বল্প সময়ের মধ্যে সকল সাংবাদিকদের নিয়ে বসে দাবি পুরনের উদ্যোগ নিব। কিন্ত গত কয়েকদিনেও তার বায়স্তবায়ন হয়নি। সে কারনে সাধারন সাংবাদিকরা বাধ্য হয়ে কমিটি বিলুপ্তের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়।
সুত্র জানায়, কমিটি বিলুপ্তসহ ৭ দফা দাবির বিষয়ে প্রেসক্লাবে রোববার দুপুরে জরুরী সভা আহবান করা হয়। সেখানে উপস্থিত প্রায় সকলেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দাবি মেনে নেয়ার পক্ষে তাদের মতামত প্রদান করে। এরজন্যে দুইজন সিনিয়র সাংবাদিককে দায়িত্ব দেয়া হয় উভয় পক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্যে। এদিকে বর্তমান সভাপতি জাফর আহমেদ নিজের পদ রক্ষার জন্যে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ও বয়োজৈষ্ঠ সাংবাদিকদের কাছে দৌড়ঝাঁপ চালাচ্ছেন। প্রেসক্লাবের সাধারন সদস্যদের তার পক্ষে নিতে নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন ও আর্থিক প্রলোভনসহ আগামীতে কমিটিতে পদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বলে বিশ্বস্থ সুত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলে ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মীরা গত ১৫ বছর ধরে টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব দখল করে রাখে। এ সময়ে প্রেসক্লাবের সাধারন সদস্য পদে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান ফারুক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য খান আহমেদ শুভ, জেলা যুবলীগের সহসভাপতি গোলাম কিবরিয়া বড় মনির ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য সুজয় দেব । আওয়ামী এসব নেতা কেউই সাংবাদিক নয়। তারা গত দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কার্যতঃ টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবকে জেলা আওয়ামী লীগের বিকল্প কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেছে। জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনসহ সকল প্রকার টেন্ডারবানিজ্য, অবৈধ নিয়োগ বানিজ্য, ভিন্নমতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা, হত্যা-নির্যাতন, নানা ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয় প্রেসক্লাবে বসে। গত ১৫ বছরে প্রতিদিন সন্ধার পর জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতাদের জুয়াখেলার আড্ডায় পরিনত হয় প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের জন্য নির্মিত রেষ্টহাউজটি। এই জুয়া খেলা চলেছে গভীররাত পর্যন্ত।
টাঙ্গাইলের সাংবাদিক সমাজের প্রানের এই প্রতিষ্ঠানকে আওয়ামী লীগের বিকল্প কার্যালয় বানানোর মূলকারিগর হিসেবে ভুমিকা পালন করেছেন প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ। সম্পুর্ন ব্যাক্তিগত স্বার্থে ও সভাপতির পদ দখলে রাখতে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রেসক্লাবে এনে তাদের সদস্যপদ দেন তিনি। একই সাথে ভিন্নমতের সাংবাদিকদের একে একে প্রেসক্লাব থেকে বের করে দেয়া হয়। টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ নিজস্ব কয়েকজন নামধারী সাংবাদিকদের নিয়ে বলয় তৈরি করে রাখেন। তার নিজের পদ ধরে রাখতে অপেশাদার অনেক সাংবাদিককে সদস্য বানিয়ে তার ভোট ব্যাংক শক্ত অবস্থানে নিয়ে নেন। তাছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ম্যানেজ করে এবং প্রেসক্লাবের সভাপতির পদ ব্যবহার করে তিনি বিপুল সম্পদ ও অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন।
তার ঘনিষ্ট স্বজনদের সুত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার উত্তরায় এবং হাতির ঝিল সংলগ্ন মহানগর প্রজেক্টে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। টাঙ্গাইল শহরের ভিক্টোরিয়া, জেলা সদর রোড, মেইন রোড ও পার্ক বাজারসহ বিভিন্ন মার্কেটে জাফর আহমদের নামে বেনামে অন্তত ৩০টি দোকান রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মুল্য কয়েক কোটি টাকা। টাঙ্গাইল রেডক্রিসেন্ট মার্কেটেও তিনটি দোকান রয়েছে। ঢাকায় তার পরিবার প্রায় ৬০ লাখ টাকা দামের জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ – ১৭-৮৯১৩) ব্যবহার করছে। টাঙ্গাইল শহরের হাউজিং প্রজেক্টে তার রয়েছে আট কাঠার একটি প্লট। বিএনপি সরকারের সময়ে তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুকে ম্যানেজ করে মন্ত্রীর ডিও লেটারে কোটি টাকার এই প্লট নিয়ে নেন তিনি। ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধুসেতু মহাসড়কের পাশে টাঙ্গাইলের ঘারিন্দা এলাকায় বিশাল জমি কিনে রেখেছেন। শহরের কাগমারায় নিজ পৈত্রিক ভিটায় বিপুল অর্থের আলিশান বাড়ি নির্মান করেছেন তিনি।
এই নেতাদ্বয় তাদের দল ভারি করার জন্য প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্র অমান্য করে অনেক অসাংবাদিককে সদস্য পদ দিয়েছেন। এছাড়াও গত ১৫ বছর বিএনপিসহ বিভিন্ন গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন যাতে করতে না পারে এজন্য কার্যকারী কমিটির সভায় রেজুলেশন পাশ করা হয়।
গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার যুগান্তকারী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান ঘটে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর টাঙ্গাইলে সাধারন শিক্ষার্থীদের উপর বারবার হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলার অন্যতম নির্দেশদাতা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম। তিনি প্রেসক্লাবে বসে থেকে এইসব হামলার নির্দেশ দেন। টাঙ্গাইলে চুড়ান্ত আন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমনের সময় ৩ আগষ্ট সকালে শহরের বিবেকানন্দ স্কুল এন্ড কলেজে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রোষানলে পড়েন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম। সেখান থেকে তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেন প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ ও সাধারন সম্পাদক নাসির উদ্দিন। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ এবং সাধারন সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নাসির উদ্দিন এখনো বহাল তবিয়তে প্রেসক্লাবে বসে পলাতক আওয়ামী নেতাদের বিভিন্নভাবে সাহস যোগানোর পাশাপাশি অর্থের যোগান দিয়ে যাচ্ছেন। গত ১৫ বছরে নির্যাতিত সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি তুলেছে প্রেসক্লাবের বর্তমান কমিটি বাতিল করার জন্য। একই সাথে আওয়ামী নেতাদের সদস্যপদ বাতিল করে প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্র সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে। টাঙ্গাইল জেলায় কর্মরত সকল প্রিন্টস ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গণমাধ্যম কর্মীরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে। এখনি কমিটি বাতিল না করলে বড় ধরনের কোন অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হলে তার জন্য বর্তমান সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক দায়ী থাকবে বলে মনে করছেন সাংবাদিকরা।
সাংবাদিকদের দাবি সমুহ ঃ
১। আওয়ামী লীগ নেতাদের অবৈধ হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে গঠিত কমিটি বিলুপ্ত করতে হবে।
২। ক্ষমতার প্রভাবে প্রেসক্লাব দখল করা আওয়ামী নেতাদের সদস্যপদ বাতিল করতে হবে।
৩। প্রেসক্লাবে সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে যোগ্য ও পেশাদার সাংবাদিকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৪। সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে স্থানীয় সংবাদপত্রের সকল কোটা পুরনের উদ্যোগ নিতে হবে।
৫। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ পদে পরপর দুইবারের বেশী নির্বাচন করতে পারবেনা – গঠনতন্ত্রের সেই পুরো ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে।
৬। প্রেসক্লাবের পদ ব্যবহার করে ও আওয়ামী নেতাদের পদলেহন করে অবৈধ অর্থ-সম্পদ অর্জনকারীদের চিহ্নিত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
৭। পেশাদার সাংবাদিকদের বৈষম্যমুলক আচরণ ও স্বজনপ্রীতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।