ঘরের খুঁটি যদি শক্ত হয় তাহলে হাজারো ঝড়ঝাপটায় ঘরটি স্বগৌরবে মাথা উচুঁ করে দাঁিড়য়ে থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবলে রায়হান হাসান ঘরের শক্ত খুঁটির মতো টানা ১০ বছর দক্ষ রক্ষণসেনা হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। পাশাপাশি হাত দিয়ে লম্বা থ্রো করে প্রতিপক্ষের রক্ষণে আতংক ছড়িয়েছেন। তার লম্বা থ্রো কাজে লাগিয়ে স্টাইকাররা গোল করেছেন। সেই রক্ষনসেনা রায়হান হাসান এখন আমেরিকার তরুণ ফুটবলারদের বাছাই কার্যক্রমে বিচারক হিসেবে আমন্ত্রন পেয়েছেন এবং যথারীতি কাজও শুরু করেছেন। এরই মধ্যে তার দক্ষতাপূর্ন কাজ আমেরিকার বিভিন্ন ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রশংসা হচ্ছে। ফুটবলের বিভিন্ন ইভেন্টে কাজ করার ডাক আসছে। যা টাঙ্গাইলবাসীর জন্য সুখবর।
আসন্ন ২০২৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট বিশ্বকাপ ফুটবলের জোয়ারে ভাসছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দল ছাড়াও পাইপলাইনকে শক্ত করতে তৃনমূল পর্যায়ে ফুটবলের চর্চায় ক্লাবগুলো ব্যস্ত। এই ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাবগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে সাবেক তারকা ফুটবলারদের বিচারক ও কোচ নিযুক্ত করছেন। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সন্তোষ রথখোলা এলাকার গর্বিত সন্তান সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার ও এএফসি সি লাইসেন্সধারী কোচ মোঃ রায়হান হাসান এখন ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাবগুলোর অনুর্দ্ধ-১৫,১৬ ও ১৭ পর্যায়ের খেলোয়াড় বাছাইয়ের দায়িত্বে।
আমেরিকান ইয়ুথ স্বকার একাডেমী ফর বাংলাদেশ ২০২৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সাবেক ফুটবলার মোঃ রায়হান হাসানকে আমন্ত্রন জানায়। পড়ন্ত বছরের ফুটবলার রায়হান হাসান “আইসাব” এর আমন্ত্রনকে সম্মান জানিয়ে আমেরিকার ফুটবল উন্নয়নে নিজেকে যুক্ত করেছেন। আমেরিকা ২০২৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাগতিক হওয়ায় তাদের দেশ এখন ফুটবল উম্মাদনায় মুখর সারাদেশ।
টাঙ্গাইল পৌরসভার সন্তোষ রথখোলা এলাকার মোঃ আব্দুল করিম ও কুলসুল বেগমের ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার ছেলে রায়হান হাসান ১৯৯৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহন করেন। বাড়ীর পাশে বড় মাঠে ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে ফুটবলকে ভালোবেসে ফুটবলকে আকড়ে ধরেন। যে কারণে পড়াশোনা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো। টাঙ্গাইলের ফুটবলার তৈরী করার কারিগর মরহুম আতিকুর রহমান জামিলের টাঙ্গাইল ফুটবল একাডেমীতে ফুটবল খেলা শেখা হয়। রায়হান হাসানের সুপ্ত প্রতিভা থেকে দেখে কোচ জামিল বস খেলাধূলার শেখার ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নিতে শুরু করেন। যা ২০০৬ সালে বিকেএসপিতে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ফুটবলে এগিয়ে যাওয়া।
তৃনমূল পর্যায়ের পাইনিয়ার ফুটবল লীগে রক্ষণসেনা হিসেবে অংশগ্রহনে তার প্রতিভার স্ফূরণ সকলের চোখে পড়ে। ২০০৭ সালে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে অনুর্দ্ধ-১৩ ফুটবলের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয় দলের পথচলার স্বপ্নে বীজ রোপন। ২০০৯ সালে তৃতীয় বিভাগে খেলার পর ২০১০ সালে প্রথম বিভাগের ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া স্পোটিং ক্লাবে যুক্ত হন। ২০১০ ও ২০১১ সালে জাতীয় দলের অনুর্দ্ধ-১৭ ও ১৯ পর্যায়ে খেলার পর ডাক আসে শিরোপা প্রত্যাশী শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব থেকে।

রায়হান তার শীর্ষস্থানীয় ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০১২ সালে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে। ২০১২ সালে লীগে রানার্সআপ হওয়ার পর ২০১৪ সালে লীগ ও ফেডারেশন কাপ উভয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন। ধানমন্ডি ক্লাবের সাথে পাঁচ বছর কাটানোর পর চট্রগ্রাম আবাহনীতে যোগ দেন। তান নতুন ক্লাবের হয়ে পেশাদার লীগে প্রথম গোলটি করেন ১৪ আগষ্ট ২০১৬ তারিখ উত্তর বারিধার ক্লাবের বিপক্ষে ৬-১ ব্যবধানে জয়লাভের মাধ্যমে।
২০১৭ সালের ১ জানুয়ারী রায়হান বাংলাদেশের সেরা ক্লাব ঢাকা আবাহনীতে যোগ দেন। ক্লাবে তার ৪ বছরের সময়কালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে(পেশাদার লীগ)১বার চ্যাম্পিয়ন ও দুইবার ফেডারেশন কাপে ট্রফি জয়লাভ করেন।২০১৯ সালে এএফসি কাপের নকআউট পর্বে পৌঁছানো আবাহনী দলের অংশ ছিলেন। ক্লাবে তার দীর্ঘ থ্রো ইনের মাধ্যমে ৬টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন।
২০২১ সালে ২১ অক্টোবর ঢাকা আবাহনী ছেড়ে ফিরে যান পুরনো ক্লাবে ধানমন্ডির শেখ জামালে। ক্লাবে ফিরে আসার পর কোচ হুয়ান ম্যানুয়েল মার্টিনেজ রায়হানকে সেন্টার ব্যাক হিসেবে রুপান্তরিত করেন। ২০২৪ সালে ক্লাবটি বন্ধ হওয়ার পর ২০২৪-২৫ সেশনে মধ্যম সারির রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস ক্লাবে এক বছর খেলেই পাড়ি জমান আমেরিকায়।
রায়হান হাসান বাংলাদেশ অনুর্দ্ধ-২৩ দলের হয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এশিয়ান গেমসে আফগানিস্থানে বিপক্ষে বাংলাদেশ অনুর্দ্ধ-২৩ হয়ে অভিষেক হয়। ২০১৬ দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে নেপালের বিপক্ষে অনুর্দ্ধ-২৩ দলের তিনি প্রথম গোলটি করেন। এই প্রতিযোগিতায় তার দল ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে।
২০১৩ সালের ৭ মার্চ ১৮ বছর বয়সে রায়হান নর্দান মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে বাংলাদেশ হয়ে আন্তজার্তিক ম্যাচে অভিষেক হয়। ম্যাচের ৮৫তম মিনিটে তিনি মিঠুন চৌধুরীর বদলী হিসেবে মাঠে নামেন। বাংলাদেশ ৪-০ ব্যবধানে ম্যাচটি জয়লাভ করে।
২০১৪ সালে ভুটানে কিংস কাপে ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হন। একই বছর ক্লাব ফুটবলে শেখ জামালের হয়ে ভারতে আই এফ শিল্টে রানার্সআপ হন। ২০১৪ সালে শ্রীলংকায় এশিয়ান কাপ পর ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়া এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহন। তিনি জাতীয় দলের হয়ে প্রায় ৫০টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা আছে।
ফুটবল খেলতে খ্যাপ থেকে প্রথম ১০০ টাকা অর্জন হলেও তিনি পরবর্তীতে ক্লাব ও আন্তজার্তিক ফুটবলের চাপে খ্যাপ খেলতে পারেননি। খেলতে পারেনি টাঙ্গাইলের মাঠে বেশী ম্যাচ। টাঙ্গাইলের ক্রীড়াঙ্গনের ফুটবল সর্ম্পকে বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন দেখতাম টাঙ্গাইলে নিয়মিত ফুটবল লীগ, উপজেলা টুর্নামেন্ট, জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ নিয়মিত হতো। কিন্তু সেই ফুটবল লীগ এবং টুর্নামেন্ট হয় না। যে কারনে এই সময়ে জাতীয় পর্যায়ে ফুটবলার তৈরী হচ্ছে না। আমাদের সময় আমি সহ বিশ্বনাথ ঘোষ, রবিউল, সুমন রেজা, রফিকুল ইসলাম, মামুন মিয়া একত্রে জাতীয় দলে খেলেছেন। এখন সুমন রেজা ছাড়া কেউ খেলার মতো নাই। জেলায় নিয়মিত খেলাধূলা আয়োজন হলে নতুন ফুটবলার উঠে আসবে। টাঙ্গাইলে ভালো মানের ফুটবল কোচ বর্তমানে নাই। ভালো মানের কোচ দরকার। টাঙ্গাইলের সাবেক ফুটবলারদের ফুটবলে উন্নয়নে কোচ হলে টাঙ্গাইলের তৃনমূল পর্যায়ের ফুটবলার ভালো প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। টাঙ্গাইলের পিযুয নন্দী, সাদেকুল ইসলাম উত্তম, মামুন মিয়া, ইউসুফ আলী খান, গোবিন্দ চন্দ্র, সাইফুল, শিপন,জাহিদ হোসেন, বিশ্বনাথ ঘোষ, সুমন রেজাদের মতো খেলোয়াড় তৈরী করতে হবে।’
তার স্বরনীয় খেলা এশিয়ান গেমসে আফগানিস্থানের বিপক্ষে। নিজ দলের অনেক ইনজুরি খেলোয়াড় থাকা স্বত্ত্বেও আফগানিস্থানকে একমাত্র গোলে পরাজিত করেন। জাতীয় দলের কোচ জেমি ডে,কাবরেরা ছাড়াও ক্লাবের আতিকুর রহমান জামিল, জিলানী,নিপু, মারুফ, টিটু, জুলফিকার মিন্টু, কায়সার, কামাল ও জাকির বাবুর অধীনে অনেক ফুটবল খেলেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রিয় খেলোয়াড় মেসি। তিনি ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসেন। অবসর সময়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পছন্দ করেন।
সি লাইসেন্স ধারী সাবেক ফুটবলার ও কোচ রায়হান হাসান বলেন, আমি আমেরিকায় এসে ফুটবলের সাথে আছি, এখানেও ফুটবল খেলছি। ছোট থেকে কিশোরদের ফুটবল সর্ম্পকে জ্ঞান দিচ্ছি। আমার ইচ্ছে, তৃণমূল পর্যায় থেকে ফুটবলার তৈরী করার জন্য একটি ফুটবল কোচিং একাডেমী করবো। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের জন্য নতুন নতুন ফুটবল উঠে আসবে। এরাই ফুটবলে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে।











